ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. তপন বাগচী

দ্বীপ গ্যালারিতে হয়ে গেল ॥ অ্যানিবডি ক্যান ডু ইট, প্লিজ ডু ইট’

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

দ্বীপ গ্যালারিতে হয়ে গেল ॥ অ্যানিবডি ক্যান ডু ইট, প্লিজ ডু ইট’

আলো বললেই ভেসে ওঠে সূর্যের আলো কিংবা চাঁদের আলো। এই তো প্রাকৃতিক উৎস! এর বাইরের আলোর উৎস হিসেবে আমাদের মনে ভাসে জোনাকি কিংবা কুপিবাতি, বড়জোর মোমবাতি বা হ্যারিকেন! কিন্তু এত রোমান্টিক যুগের কথা। এখন আলো বললে মোবাইলের টর্চ কিংবা বিদ্যুতের বাল্বই তো মনে আসবে। নাজিব তারিক বিমূর্তকলার সূত্র ধরে যে আলো (১৯৮৯) এঁকেছেন তাতে বৈদ্যুতিক বাল্বের অবয়ববেই ভাসে মানুষের মুখ! কেন সে মানুষ? আলোকিত মানুষ। যেন যে রবীন্দ্রনাথ। হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথই তো আমার অনন্ত আলোর উৎস! কিন্তু আজ থেকে ৩০ বছর আগে আঁকা শিল্পীর সেই ছবি এখনও প্রাসঙ্গিক। সেই ছাত্রজীবনে জলরঙে আঁকা ‘নীলপাখি’, ‘চোখ’, ‘দেহ ও মন’, শিব’, ‘শিরোনামহীন’ নামের চিত্রকর্মগুলো সাম্প্রতিক আঁকার সঙ্গে মিলিয়ে লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে হয়ে গেল নাজিব তারেকের চিত্রপ্রদর্শনী ‘বিমর্তুতার গালগল্প’। এর একটি ইংরেজী উপশিরোনাম আছে, ‘এ্যানিবড়ি ক্যান ডু ইট, প্লিজ ডু ইট’। এই শিরোনাম কেন বিভাষায় রচিত, তা আমার বোধে আসছে না! তা হোক। বিভাষীরা যদি আকৃষ্ট হয়, তাতে চিত্রকলারই লাভ! নাজিব আমাদের বন্ধু! একসময় কবিতা লিখতের। তারপর তিনি কবিতা থেকে ক্রমশ চিত্রকলায় বুঁদ হন। কিন্তু কবিতা তাঁকে ছাড়ে না। চিত্রকলার মধ্যে সে কবিতার বীজই বপন করেন। মনে পড়ে, ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্পে ‘বাংলা কবিতার চিত্রায়ন’ শিরোনামে তিনি বইও লিখেছেন। দেশের তাবৎ পত্রিকায় তিনি চিত্রকলা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। আমাদের চিত্রকলার ইতিহাসটা তাঁর জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি চারুকলায় শিক্ষা সমাপন করেছেন। অর্থাৎ আঁটঘাট নেমেই তারেক আঁকাআঁকির মাঠে খেলতে নেমেছেন। ব্যক্তিগত, ঘরোয়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং পুরস্কারপ্রাপ্তির পরে নাজিব তারেক কেন তাঁর প্রদর্শনীকে গালগল্প বলতে চান, সেটিও ভাবার বিষয়! ‘আঁক কেটেছি আকাশে ০৬’ চিত্রের যে আকাশ তাকে আমি প্রায়শই দেখি। মেঘময় আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখি। দেখি আর মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। আবার কখন যে আসবে তার কোন নিয়মনীতি নেই। তখন নিজের মনেই তার উপস্থিতি ঘটতে হয়। নিজের মনেই আঁকা হয় অমন নানা ছবি। আর তারই একটি খ- এক্রিলিকে এঁকেছেন নাজিব তারেক। ‘আঁক কেটেছি আকাশে ১০’ (২০১৫) চিত্রে আকাশকে কেউ ঘরের ছাদ কিংবা মেঝেও কল্পনা করতে পারি। কিন্তু রঙের বিন্যাস এতটাই মুগ্ধকর যে শিল্পরসিক না হলেও তার রস নিতে কোন সমস্যা হয় না। আঁক কেটেছি আকাশে ১১’ (২০১৫) চিত্রে আমরা বহুবর্ণিল আকাশকে দেখতে পাই, যা চেনা আকাশের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু আকাশে মেঘের খেলা, ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো, রংধনুর সাত রং মিলিয়ে আকাশ যে এক রহস্যময় পট, প্রকৃতি নিজেই সেখানে ছবি আঁকে, আমরা কজন তাঁর খবর রাখি। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমরা কত কিছু দেখি! সেই কতকিছু থেকে কিছুকিছু নিয়ে নাজিব আঁকলেন নতুন এক অবয়ব। সুনির্দিষ্ট কোন মূর্তি বা ফিগার নেই বলে কি একে বিমূর্ত বলে চালানো কি ঠিক হবে। এতে তো জীবন্ত আকাশের মূর্তি! সাত রঙের খেলা দেখিয়েই নাজিব তারেক আঁকলেন অধরা আকাশের ননুন এক রূপ! একই সিরিজের ‘আঁক কেটেছি আকাশে ১২’ (২০১৭) নামের ছবিটিও তাকিয়ে দেখার মতো। জীবননান্দ দাশের ‘ধূসর পা-ুলিপি’র পাঠ প্রতিক্রিয়ায় জানানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে নাজিব তারেকের ছবি দেখে হয়তো এমন মন্তব্যই করতেন। অন্তত আমি তো এ মন্তব্য করতেই পারি, ‘তারেকের আঁকায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে, তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে’। হয়তো সবটুকু বুঝতে পারি না, কিন্তু আনন্দের তাতে ধরা দিতে সমস্যা হয় না। আমাদের অনেক বড় বড় কবি একপর্যায়ে ছবি এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো চিত্রশিল্পী হিসেবেও অনেক বড় কৃতিত্বের দাবিদার। আমাদের কবি সৈয়দ শামসুল হকও চেষ্টা করেছেন ছবি আঁকতে। আর কবি নির্মলেন্দু গুণ তো প্রদর্শনীও আয়োজনও করেছেন। বিক্রিও হয়েছে তাঁর ছবি। কেবল শখের বশে নয়, কবিতায় ধরতে না পেরে তুলির আশ্রয় নিতে নয়, একেবারেই পেশাদারিত্বের ভঙ্গিতেই তিনি রং তুলি হাতে নিয়েছেন। আর নাজিব দেখছি কবিতা লিখতে লিখতে গিয়ে শিল্পী হয়েছেন। এখন রং তুলি দিয়ে কবিতা আঁকেন। তাঁর ‘ধাক কেটেছি আকাশে’ সিরিজ দেখে আমার এমনই মনে হলো। দ্বীপ গ্যালারিতে নাজিব তারেকের ছবির প্রদর্শনী চলছে। ২৯ নবেম্বর শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। উদ্বোধনীর মুহূর্তে থাকতে পারিনি। সেই কষ্ট লাঘব হয়ে গেল একা একা দেখে এসে। কথাটি এই কারে পাড়লাম যে, এই প্রদর্শনী একা দেখলেই ভাল লাগে। হল্লার মধ্যে এই ছবির রস পাওয়া কঠিন। যতই শিল্পী একে বিমূর্ততার গালগল্প হিসেবে চিহ্নিত করুক, আমি তো এর ভেতর থেকেই খুঁজে নিয়েছি আমার বোধের জগতে লুকিয়ে থাকা ছবি। খুই ছিমছাম এই আয়োজন। চিত্র সমালোচকদের কাছে এই ছবিগুলো কোন মাত্রায় মূল্য পাবে, জানি না। এইটুকু বলতে পারি আমরা যারা শব্দ দিয়ে বাক্য দিয়ে ছবি আঁকতে চাই, এই প্রদশনী থেকে তাঁদের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। প্রতিটি ছবি দেখার পরে মনে মধ্যে যে উপলব্ধির জন্ম হয়, তা তো এক ধরনের কবিতাই। আমি দ্বীপ গ্যালারিকে ধন্য জানাবো এ রকম চিত্রশিল্পীকে খুঁজে আনার জন্য, যারা আঁকার ক্ষমতা আছে, প্রকাশের স্বকীয়তা আছে, রং নিয়ে খেলার দক্ষতা আছে। নাজিব তারেক এ রকম মাঝে মাঝে নতুন ঘোর তৈরি করতে নতুন চিত্রকলা নিয়ে আসবেন, সেই প্রত্যাশা রইল।
×