ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

অমর্ত্যে মর্ত্যরে নবনীতা

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

অমর্ত্যে মর্ত্যরে নবনীতা

মর্ত্যরে নবনীতা এক অপার্থিব রঙধনু। বর্ণে বর্ণে বিকীর্ণ শোভায় বিভাময়ী, বিদ্যুন্ময়ী। অঙ্গে অঙ্গে প্রজ্ঞাবতী এবং প্রভাবতী। শোণিতে কবিত্বের উত্তরাধিকারের শুদ্ধ প্রবাহ, মেধায় বিজলির চমক জাগানো দ্যুতি আর মননে বাংলার সোঁদামাটির ঘ্রাণ। নবনীতার চারিত্র সংগ্রামে ঋদ্ধ, সংযমে সংহত আর সৌন্দর্যে অনাবিল। ঔদার্য আর মানবিকতা নবনীতার কনক-কিরীট। অচেনা এক চড়ুই নিয়ে তিনি ‘শ্রদ্ধা’য় উপনীত। এ চড়ুই ক্ষুদ্র পাখি নয় কোন। এ চড়ুই এক ছোটখাটো বৃদ্ধার নবনীতা প্রদত্ত নাম। এবং তা প্রথম দেখাতেই। নিজের গর্ভের পুত্র কর্তৃক পরিত্যক্ত এক বৃদ্ধাকে সোদপুর রেলওয়ে প্লাটফর্মে পেয়ে নবনীতা দেবসেন মুহূর্তেই হয়ে ওঠেন মা অন্নপূর্ণা। নিজহাতে তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন পরিত্যক্তা বৃদ্ধাদের আশ্রয়ে যার নাম ‘শ্রদ্ধা’। পরিচয়ের প্রথম দিন হতেই নবনীতা দেবসেন তাঁর ‘চড়ুই’ এর মা হয়ে তার সকল ব্যয় অগোচরে বহন করেন। মৃত্যুর শেষকৃত্যেও নবনীতার নিঃশব্দ সহযোগিতা ছিল ফল্গুধারার মতো। একজন নবনীতা দেবসেন এইসব কর্মের মাঝেই তাই হয়ে ওঠেন অমর্ত্য অনায়াসে। ‘ভাল-বাসা’র মানুষ নবনীতা যার প্রথম জীবনের ভালবাসার মানুষের কথা তিনি প্রকাশ করেছিলেন প্রতিভাধর কবি মা রাধারানীর কাছে। মা রাধারানীও মেয়ের এই প্রেম মেনে নিয়ে আরোপ করেছিলেন তিনটি শর্ত। পর্দা ঘেরা রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাবে না, সন্ধ্যার পর লেকের পাড়ে থাকা চলবে না এবং প্রেমিকের সঙ্গে সিনেমায় যাওয়া চলবে না। মায়ের শর্ত মেনে নিয়ে প্রেমে পড়া কলেজগামী মেয়ে এরপর ধীরে ধীরে প্রেমে পড়িয়ে ছাড়ল অগণিত পাঠককে তাঁর হৃৎকমল আর শ্বাস কমলের টানে। বাবা কবি নরেন্দ্র দেব এর তৈরি করা বাহাত্তর হিন্দুস্থান পার্কের ‘ভালবাসার বারান্দা’ হতে নবনীতা দুহাতে লিখে গেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী আর প্রবন্ধের পদ্মকুসুম। নবনীতা সাহিত্যের সাম্রাজ্যে নিয়ে এলেন নিজস্ব ভঙ্গি আর নিজের ভাষা। অসাধারণ ট্রাভেলগের রচয়িতা নবনীতা যেন রসের অতল কুম্ভ। ‘প্রথম প্রত্যয়’ এর কবিতা দিয়ে শুরু করে নবনীতা বগলদাবা করেছেন কথাসাহিত্যের আঙিনাটুকু। ‘আমি,অনুপম’ তাঁর প্রথম উপন্যাস যেখানে পুত্রের আর্তনাদ শুনতে না পাওয়া এক মায়ের কথা বিধৃত আছে। এখানেই থেমে না থেকে নবনীতা চলে গেছেন ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’। যেতে যেতে আটত্রিশটি গ্রন্থের রচয়িতা নবনীতা সর্বশেষ ‘তুমি মনস্থির কর’ কাব্যগ্রন্থে এসে থেমেছেন। মৃত্যুর মাসখানেক আগে নয় অক্টোবর তিনি ক্যান্সারকে নিয়ে রসিকতা করে লিখেছেন, ‘কর্কটকমলের এত মাতুব্বরি কীসের? তার লাঠিসোটা একটু বেশি বলে?’ প্রথাগত সকল ধর্মীয় আচরণ নবনীতা পালন করেছেন তাঁর বাবা-মার শেষকৃত্যে যখন তাঁকে মন্ত্রপাঠ করিয়েছেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু নিজেই লিখে গেছেন প্রবন্ধ সংকলন ‘ঈশ্বরের বিরোধিতা ও অন্যান্য’। এমনকি ‘রামকথা’তে তিনি রামায়ণের রামকে পুরুষোত্তম বলে প্রতিষ্ঠিত না করে নারীর চোখে রামায়ণকে দেখার চেষ্টা করেছেন। যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে এপিক পড়াতে গিয়ে তিনি রামায়ণ, মহাভারতকে কোন ধর্মীয় কাহিনী নয়, সাহিত্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন শিক্ষার্থীদের মনে, যেমনটা অডিসি, ইলিয়াড ইত্যাদি। রাম কিংবা ভীম-অর্জুনকে তিনি হেক্টর, এ্যাকিলিসের মতোই ব্যাখ্যা করেছেন। মধ্যযুগের বাঙালী ব্রাহ্মণ কবি চন্দ্রাবতী এবং অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু ভাষার মহিলা ব্রাহ্মণ কবি মল্লার রামায়ণে তিনি কাহিনীর সত্যতা বজায় রেখে ভিন্ন স্রোতধারা বয়ে যেতে দেখেছেন। এসব রামায়ণে সীতার চোখে রামের অবস্থান কোথায় তা দেখার সুযোগ তিনি লাভ করেছেন গবেষণার কারণে। রাম এখানে পুরুষোত্তম নয়, রাম এখানে মহাকাব্যের নায়ক। নবনীতার গবেষণায় মহাকাব্যের যে আটত্রিশটি উপকরণ খুঁজে পাওয়া গেছে তার মধ্যে কেবল নয়টি নারীর জন্য উপযোগী। তার মানে নারী কখনোই মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র হতে পারবে না। এর মূল কারণ নিহিত আছে রচয়িতায়। মহসকাব্যের রচয়িতারা সবাই পুরুষ। এই সত্য উদ্ঘাটন করেও নবনীতার নারীবাদ কখনও উচ্চকিত কিংবা ধ্বংসাত্মক ছিল না। তাঁর নারীবাদ হয়ে উঠেছে মানবীবিদ্যা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যার জননী হয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন নারীদের। মা রাধারানীর মতো সংগ্রামী এক নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে নবনীতা নারীদের নিয়ে গেছেন নিজস্ব পথে, পুরুষের সঙ্গে অসহযোগ করে নয় বরং নিজস্ব কর্মপন্থায়। এরই স্বপ্নবীজ আমরা দেখি ‘সই’ নামে তাঁর আলাদা নারীগোষ্ঠী তৈরিতে। দুহাজার সালে মায়ের নামে নারীদের বইমেলা ‘সইমেলা’র মাধ্যমে তিনি মানবীবিদ্যাকে সত্যিকার অর্থেই দিয়ে গেছেন এক স্বতন্ত্র মঞ্চ। যদিও ‘সই’ এর তিনটি ভিন্ন অর্ত আছে। তবে সই বা স্বাক্ষর, সই বা বন্ধুকে মেনে নিলেও তিনি সই বা সয়ে যাওয়াকে অত মেনে নিতে নারাজ। অকারণ বদনাম সইতে পারেননি বলেই অক্সফোর্ডে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর কাছে তাকে পেতে হয়েছে ‘দজ্জাল’ অভিধা। অথচ নবনীতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান শুনেই নীরদ চন্দ্র চৌধুরী এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ধাপ্পা বলেছিলেন এবং তার অধ্যাপনার বিষয় ‘তুলনামূলক সাহিত্য’কেও তিনি ‘ধাপ্পা’ বলতে দ্বিধা করেননি। মুখের উপর এই বদনামির যুৎসই জবাব দেয়াতে তিনি হয়ে যান দজ্জাল। নবনীতার সবচেয়ে বড় রসিকতা ছিল তার রোগজীর্ণতাকে নিয়ে। কখনও রোগে ভেঙে পড়েননি তিনি। জীবনকে ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন বলেই তিনি জীবনের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে গেছেন। তাঁর ভাষ্যে তাঁর দেহের সবকটা দরজারই তালাভাঙা। তাঁর শ্বাসকমল হতে হৃৎকমল সবই উন্মুক্ত। তাঁর এই উন্মুক্ত উদার ব্যবহারের কারণেই তাঁর কাছে সাহিত্যের নাম দিয়ে ভিড় করত যে কেউ। অপরিচিত কেউ কেউ তাঁর কাছে নিয়ে আসত কবিতা তাঁর একটা মূল্যবান সমালোচক মন্তব্যের জন্য। এ রকম একটি ঘটনা আমরা জানতে পাই তাঁর বিচ্ছেদ হওয়া স্বামী অমর্ত্য সেনের মুখে। কেন এক ক্ষ্যাপা কবি একবার নবনীতার বাসায় এসেছিলেন তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে স্বকণ্ঠে নিজের একশ’টা কবিতা শুনিয়ে নবনীতার দুটো মূল্যবান মূল্যায়নধর্মী মন্তব্য শোনার জন্য। কিন্তু কোন কারণে সেদিন নবনীতা ছিলেন না তাঁর বাড়িতে। ঘটনাচক্রে অমর্ত্য সেন সেদিন বাড়িতে ছিলেন। নবনীতাকে না পেয়ে ঐ ক্ষ্যাপা কবি অমর্ত্যকে নিয়েই পড়লেন। বললেন, সাধারণ মানুষেরও দরকার আছে তার কবিতা শোনার। কবিরও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানার প্রয়োজন আছে। রবীন্দ্রনাথের গান সেই ছোট বয়স হতেই নবনীতার সঙ্গী। মা রাধারানীর মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে তিনি ঘুমিয়ে যেতেন শৈশবে। সেই ছোট্ট মেয়েই জীবন শেষে চিরতরে ঘুমিয়ে গেল মেয়েদের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথকে শুনতে শুনতে। এমনকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হলে তাঁর শবদেহ, তাঁর সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম...‘গান শুনিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। রবীন্দ্রনাথের দেয়া নামকে সাথী করে নবনীতা সংসার পেতেছিল আরেক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর সঙ্গে। অমর্ত্য সেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর প্রতিভাকে সম্মান করে বলেছিলেন, ‘নবনীতার অসাধারণ প্রতিভা’। যদিও সে সংসার উনিশশো ছিয়াত্তরে এসে ছিন্ন হয়ে গেছে, কিন্তু দুজনের যোগাযোগ সরাসরি না হলেও একেবারেই ছিন্ন হয়নি। দু’মেয়ের মারফতে নবনীতার খোঁজ পেতেন অমর্ত্য। যেদিন নবনীতা ছেড়ে যায় ইহধাম সেদিন তিনি ক্লাস নিচ্ছিলেন হার্ভার্ডে। একটা ফোনের ডাকে তাঁর কানে এলো চরমতম দুঃসংবাদ। নবনীতার মৃত্যুতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিকটজনদের কাছে অমর্ত্য ব্যক্ত করেছেন তাঁর শেষ শ্রদ্ধা এই বলে, ‘আর কলকাতা গিয়ে কী হবে? যার জন্যে যেতাম সে-ই তো চলে গেল।’ অমর্ত্য’র সঙ্গে নবনীতার চেনাজানা সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। তখন নবনীতা তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী আর অমর্ত্য তরুণ অর্থনীতির শিক্ষক। সরাসরি ছাত্রী না হলেও ডিবেটিং সোসাইটির মাধ্যমে তাদের পরিচয়। সেই পরিচয় বাগদানে পরিণত হয় পথেই। অর্থাৎ নবনীতা যখন কেমব্রিজে পড়তে যান তখন তাদের আংটি বদল হয়। তারপর সেই সিটি অফ জয়-এ এসে হয় মালাবদল। মানুষকে কখনও তুচ্ছ করেননি নবনীতা। সেই সুদূর হুগলী থেকে তাঁর কাছে নিয়মিত আসা এক মহিলাকে তিনি দিনের পরদিন সহযোগিতা করেছেন তার গায়ে তীব্র দুর্গন্ধ থাকা সত্ত্বেও। এমনকি নিজেই তার ব্যবহার করা টয়লেট পরিষ্কার করেছেন, তবু অশোভন কিছু থেকে নিজেকে রেখেছেন দূরে। নবনীতার সাহিত্য যতটা না উপাখ্যান নির্ভর তার চেয়ে অধিক শৈলী নির্ভর। তার ভাষা ও ভাবের বিস্তারে সাহিত্য হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো। দুই মেয়েকে নিয়ে সংগ্রাম করে যাওয়া নবনীতার উদ্যম ছিল অপরাজিতা। বিয়ের পর আরো একটা মাস্টার্স, একটা পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা নবনীতাকে সত্যিকার অর্থেই বানিয়ে তুলেছে গ্লাডিয়েটর। ক্যান্সারের সঙ্গে সহবাস করে, ক্যান্সারকে কাঁচকলা দেখিয়ে, শ্বাসের রোগের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নবনীতা জয় করেছে কোটি মানুষের হৃদয়। উনিশশো নিরানব্বই সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘নটী নবনীতা’ প্রকাশিত হয়। আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হওয়া নবনীতা দুহাজারে ‘পদ্মশ্রী’ হয়ে ওঠেন ভারতের। ব্যক্তিজীবনে নবনীতার অমর্ত্যরে প্রতি কোন ক্ষোভ নেই বলেই অস্ট্রেলিয়ান এসবিএস রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন ‘আই হ্যাভ নো ‘কম্পেইন্টস্’। তবে দীর্ঘশ্বাস যে ছিল না তা নয়। নবনীতার পিসিমা আশাপূর্ণ দেবী নবনীতার বিয়েতে একটা সুন্দর বেডশিট দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। নবনীতা অনেক বছর পর সেই স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে বলেছেন, ‘পিসিমার সেই বেডশিট আজও আছে কিন্তু পিসিমার জামাই এর বউ এখন আরেকজন।’ আর ওদিকে অমর্ত্য অকপটে স্বীকার করেন,‘আই লার্নড মেনি থিংগস্ ফ্রম হার, ইনক্লুডিং এ্যাপ্রিসিয়েশন অফ পোয়েট্রি ফ্রম এ্যান ইন্টারনাল পারস্পেক্টিভ।’ বংশের পদবি দেব ধারণ করে নবনীতা অমর্ত্যরে সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর দেবসেন হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিচ্ছেদের পরও সেই ‘সেন’ লেগে থাকলো তাঁর নামে। মৃত্যুযাত্রায় লালপাড় সাদা শাড়ি আর কপালের লালটিপ সেই বাহ্যিক বিচ্ছেদের সাময়িকতাকে কাটিয়ে এটাই জানান দেয়, অমর্ত্য হয়ত জড়িয়ে আছে নবনীতার আবহমান বাঙালী নারীত্বের আভরণ হয়ে। মর্ত্যরে নবনীতা জীবনকমলকে বিকশিত করে, নির্ধারিত নিয়তির বশ্যতা স্বীকার করে পাড়ি জমিয়েছেন অমর্ত্য,ে পেছনে রয়ে গেল মর্ত্যরে অমর্ত্যজীবন আর তাঁর শোণিতে গাঙের বানডাকা ভাবের কল্লোল। সেই কল্লোলে নবনীতা চিরসবুজ হয়ে থাকবেন ‘ভাল-বাসা’র বারান্দায়।
×