ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাবলম্বী হচ্ছে উদ্যমী মানুষগুলো

পায়রায় বদলে গেছে জমিহারা মানুষের যাপিত জীবন...

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯

পায়রায় বদলে গেছে জমিহারা মানুষের যাপিত জীবন...

মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ লড়াকু নারী তাসলিমা। জীবনের প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে রাত-দিন লড়াই করেই কাটছিল তার কষ্টের সংসার। হঠাৎ করেই পায়রা বন্দর যেন বদলে দিল তার জীবন ও সংসারের গতি-প্রকৃতি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এই বন্দর নির্মিত হওয়ায় তাসলিমা বেগমের জীবনেও এখন বইছে সুবাতাস। দিন বদলের লড়াইয়ে সাফল্যের সোনালি সময় পার করছেন এখন তিনি। বলা যায়, স্বাবলম্বী হওয়ার দৌড়ে সফল তাসলিমা বেগমের পরিবার। রঙিন স্বপ্নে বিভোর এই আত্মপ্রত্যয়ী এই নারী হাঁস পালনের মধ্য দিয়ে জীবন-সংসারে হাসি ফোটাচ্ছেন। সফলতাও হাতছানি দিয়েছে তার জীবনে। এখন দৈনিক কমপক্ষে দেড় হাজার টাকার ডিম বিক্রি করছেন। স্বামী হেলাল ফকির দোকানি। ছেলে নাইম সপ্তম শ্রেণীতে এবং মেয়ে নাদিয়া ক্লাস টুতে পড়ছে। গোটা এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বলে তাসলিমা বেগমের মতো আরও অনেকের পরিবারে আজ হাসি ফুটেছে। পায়রা বন্দর নির্মিত হওয়ায় যেন বদলে যাচ্ছে পুরো অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবন। বিশেষ করে জমিহারা পরিবারগুলোর দিন। কঠিন আর্থিক অনটন থেকে উঠে আসছেন এসব পবিারের মানুষ। তাদের পেশায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হাইলা-কামলা, জেলে পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিজেকে গড়ে তুলেছেন প্রশিক্ষিত কর্মদক্ষ জনশক্তিতে। তাদের বাড়িঘর জমিজমা যা ছিল সবটুকু পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করেছে। প্রথমে তারা ভড়কে গিয়েছিল। এখন তাদের হতাশার জীবনে স্বস্তির নিশ^াস নিচ্ছেন আলোচ্য নারী তাসলিমার মতো আরও অনেকে। তাদের কেউ স্বামীকে অথবা কোন স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে পারিবারিক উন্নয়ন কাজে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ফলে তাদের জীবন-সংসারকে আর্থিক সাফল্যের কাছাকাছি টেনে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এ কারণেই পরিবারগুলো এখন হাঁটছে সাফল্যের পথে। সরকার পায়রায় অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ৪২০০ পরিবারকে গৃহপুনর্বাসন ছাড়াও কর্মদক্ষতার উন্নয়নে শুরু করা বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণে অন্য সবার সঙ্গে হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ দেন তাসলিমা বেগম। সফল প্রশিক্ষণের পুরস্কার বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ভাতা ছাড়াও পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। তাই দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। প্রায় ৯/১০ মাস আগে দেন হাঁসের খামার। পরিকল্পিতভাবে তিনি হাঁস পালন শুরু করেন। ১৮ দিনের ওই প্রশিক্ষণে হাঁস পালন পদ্ধতি রপ্ত করেন অদম্য এ নারী। খামারের পরিধি বাড়াতে সোনালি ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে চার শ’ হাসের বাচ্চা কেনেন। প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। হাঁসের ঘর, জালের বেড়াসহ এক দফা খাবার কিনতে। এখন গড়ে ফি-দিন এক থেকে দেড় শ’ হাসের ডিম পাচ্ছেন তাসলিমা। বাড়ি থেকেই পাইকার ১০টাকা করে ডিম কিনে নেয়। আগে ২৮০/২৯০টি ডিম পেতেন। কিন্তু বিধি কিছুটা হলেও বাম। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের রাতে জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা হাঁসের ঘরে লাগে, এতে ভয় পেয়ে ১৫৫টি হাঁস মারা গেছে তাসলিমার। তারপরও থেমে নেই। দৈনিক দুই বস্তা খাবারসহ নিজের পরিশ্রম নিয়ে গড়ে দৈনিক হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তারপরও মাসে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। এছাড়া হাঁসের দাম তো পুঁজি হিসেবে পড়ে আছে। এ নারী এখন প্রচ- আত্মপ্রত্যয়ী, স্বামী সংসার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন পার করছেন। বাড়ি-ঘরের ক্ষতিপূরনের টাকা পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার পেয়েছেন। তবে জমির টাকা পায়নি। প্রশিক্ষণের আগেও সাধারণ এ গৃহিনী সংসারের জোগান দিতেন। আর এখন উপার্জনের প্রধান ব্যক্তি হয়ে আছেন। দক্ষতার উন্নয়নের একটি প্রশিক্ষন এ নারী যেন স্বপ্ন দেখছেন জীবনের সফলতার। মাঝে-মধ্যে হাঁসও বিক্রি করেন। আড়াই শ’ হাঁসের মধ্যে ১০টি হাঁসা রেখেছেন। টানা তিন মাস ডিম দিচ্ছে হাঁসগুলো। অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় করেছেন তাসলিমা। এ যেন প্রশিক্ষণের শেখা। এ নারী এখন উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের কলাউপাড়া গ্রামের মডেল হয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পায়রা বন্দরে ক্ষতিগ্রস্ত জমি হারা প্রত্যেক পরিবারকে গৃহপুনর্বাসনের কাজের পাশাপাশি ৪ হাজার ২শ’ পরিবার থেকে একজনকে করে কর্মদক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার। তারই ধারাবাহিকতায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বেসরকারী সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওর (র্ডপ) ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে ১০টি ট্রেডে ১১শ’৩৪ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। পরবর্তীতে এ বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে আগামী ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বেসিক কম্পিউটার, গাড়িচালক, রাজমিস্ত্রি, পোশাক তৈরি, ওয়েল্ডিং, ছাগল পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, ব্রয়লার ককরেল ও টার্কি পালন, মৎস্যচাষ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ, উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস-মুরগি পালন ও হাঁস মুরগির খাদ্য তৈরি, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারপূর্বক পারিবারিক পরিম-লে গাভী পালন ট্রেডে ২৬ ব্যাচে মোট ৬শ’৬৬ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, দুই ব্যাচে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৫০ জন বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। র্ডপ টিম লিডার জেবা আফরোজ জানান, বর্তমানে লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ, ধানখালী ইউনিয়ন পরিষদ, কেআইআইটি ও মাল্টিপারপাস বিল্ডিং, পায়রা বন্দর, কলাপাড়া ও পটুয়াখালীতে প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। ৬ মাস, ৩ মাস, এক মাস, ২১ দিন মেয়াদী প্রশিক্ষণ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণগুলো দক্ষ প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন এম. মুনিরুজ্জামান জানান, সরকার পায়রা বন্দর নির্মাাণের ফলে ভূমি ও গৃহ অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের পর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সব পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান যাতে ব্যাহত না হয়, তারা যাতে উন্নত জীবন যাপন করতে পারেন, সে জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করতে তাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণের পরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছে। তারা ব্যবসা করে জীবন মানের উন্নয়ন করতে শুরু করেছে। প্রশিক্ষণের পর তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ কাজে প্রশিক্ষণ পরবর্তী মনিটরিংও চলে। এসব পদক্ষেপে এখন পায়রা বন্দরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এক ধরনের উদ্যমী মানসিকতা তৈরি হয়েছে স্বাবলম্বী হওয়ার।
×