ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক অজয় রায়ের জীবনাবসান

প্রকাশিত: ১১:১৩, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯

অধ্যাপক অজয় রায়ের জীবনাবসান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পেশায় শিক্ষাবিদ হলেও দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্দোলনে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। সোমবার প্রিয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সেই পদার্থবিদ অধ্যাপক অজয় রায়। এদিন বেলা সাড়ে ১২টায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিযোদ্ধা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক। ৮৪ বছর বয়সী এই অধ্যাপককে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। ২৫ নবেম্বর জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক এই অধ্যাপক। ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট বাড়লে দুইদিন পর থেকে তাকে কৃত্রিম শ্বাস দেয়া শুরু হয়। অধ্যাপক অজয় রায়ের ছোট ছেলে অনুজিৎ রায় জানান, তার বাবার কফিন রাখা হবে বারডেমের হিমঘরে। মঙ্গলবার সকালে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বেইলি রোডের বাস ভবনে? সেখান থেকে সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তার মরদেহ বারডেম হাসপাতালে দান করা হবে। অজয় রায়ের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী তার আত্মার শান্তি কামনা করেন। একইসঙ্গে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়াও অজয় রায়ের মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে শোক জানিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ বিশিষ্টজনরা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোক জানিয়েছে বাংলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। শুধু একজন খ্যাতনামা পদার্থবিদ বা অধ্যাপকই নন, অজয় রায় ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মুক্তমনা মানুষ। সেই সুবাদে নিজ সন্তানকে গড়ে তুলেছিলেন সব ধরনের কলুষতামুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে। বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায় ছিলেন তার বড় ছেলে। ২০১৫ সালে একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নৃশংস হামলায় অভিজিত রায়কে প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই হত্যা মামলায় গত ২৮ অক্টোবর আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন অজয় রায়। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক অজয় রায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন। সর্বশেষ তিনি নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। পদার্থবিদ অজয় রায়ের দুটি গবেষণা নোবেল কমিটিতে আলোচিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অবসরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইউজিসি অধ্যাপকও ছিলেন অজয় রায়। মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ভাষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও। ড. অজয় রায় ১৯৩৫ সালের ১ মার্চ দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রায় সব গণতান্ত্রিক ও নাগরিক আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন তিনি। স্কুল ও কলেজ জীবনে অজয় রায় পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুরে। ১৯৫৭ সালে এমএসসি পাস করে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ১৯৫৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। এর মাঝে ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রী। ১৯৬৭ সালে সেখানেই করেন পোস্ট ডক্টরেট। ১৯৬৭ সালে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করেন এবং অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলেন অজয় রায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে আগরতলা হয়ে কলকাতায় গমন করেন। সেখানে মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উত্তরসূরি হিসেবে একাত্তরের মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। অজয় রায় বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়ার পর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। মুক্তমনার উপদেষ্টাম-লীর সদস্য হিসেবে জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি মুক্তান্বেষা পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন; যার লক্ষ্য ছিল সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা। কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও ছিল তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
×