ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে বিজয়ের মাস

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯

সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে বিজয়ের মাস

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বহু কাক্সিক্ষত বিজয়। বিজয়ের নতুন সম্ভাবনায় সারা বাংলা যখন উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত ঠিক তার দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ঘটে যায় আর এক মর্মান্তিক রক্তপ্লাবন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেভাবে পাশবিক নৃশংসতায় হত্যার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করা হয় তা দেশের ইতিহাসের এক চরম কলঙ্কিত অধ্যায়। শুভ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে অশুভ অপশক্তির কালো ছায়ায় সারা বাংলা অন্ধকারে ডুবে গেল। স্বাধীনতার সূর্য যখন প্রভাতের রক্তিম আভায় উদয়ের সন্ধিক্ষণে তেমন আনন্দঘন মুহূর্তটি কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো। শেষ অবধি সূর্য ওঠার আগে দেশ বেদনায় ম্লান হলেও রবির কিরণ বাংলার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়েও পড়ে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটির স্থপতি তখন পর্যন্ত পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কূটকৌশলে কারা অন্তরীণের আড়ালে। সে মাত্রায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অধীর অপেক্ষায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির প্রত্যাশায়। যাঁর সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক পথ পরিক্রমায় স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত পটভূমি তৈরি হতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধুর সচল উপস্থিতি ব্যতিরেকে বিজয়ের পথ সাময়িকভাবে সবাইকে বিষণœতায় ভরিয়ে তুললেও কিছুদিনের মধ্যে তেমনি ভারাক্রান্ত হৃদয় নতুন আলো আর আনন্দে উদ্ভাসিতও হয়ে ওঠে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস কত ত্যাগ, তিতিক্ষা, কত জীবন আহূতি দেয়া এবং লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে যে জয়যাত্রা তার পথপরিক্রমা পার করছিল তা ছিল এক নদী রক্ত পেরোনোর দুর্গম, পিচ্ছিল রাস্তা। স্বাধীনতা সূর্যকে অর্জন করার চাইতেও বেশি সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তাকে ছিনিয়ে আনার বিক্ষুব্ধ লড়াই। যে বৈপ্লবিক অভিগমনে অংশ নিয়েছিল দেশের সিংহভাগ সচেতন নাগরিক। দেশাত্মবোধের চেতনা আর মুক্তি সংগ্রামের আদর্শিক এই লড়াইয়ে কতিপয় পাকিস্তানী দোসর যারা বাঙালী হওয়ার কোন যোগ্যতা রাখে না। তেমন স্বাধীনতা বিরোধীর সংখ্যা অল্প হলেও চরম ত্রাস ও বিভীষিকা তৈরিতে যে মাত্রায় সিদ্ধহস্ত ছিল তার দৃষ্টান্তও নয় মাসের রক্তস্নাত বাংলার অনন্য নজির। শ্যামল সবুজ বাংলায় রক্তের আলপনায় আঁকা হয়েছিল লাল সবুজের পতাকা। যে পতাকার মর্যাদাকে বার বার লুণ্ঠিত করতে চেয়েছে পাকিস্তানী ও দেশীয় দুর্বৃত্ত শক্তি। যে অপশক্তি তার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারে আজও সক্রিয় এবং সজাগ। একাত্তরের বিজয় এবং সংগ্রামী মাসগুলোকে বিবেচনায় আনতে সর্বপ্রথম আলোকপাত করা সঙ্গত পুরো মার্চ মাসের লড়াকু তাৎপর্য। তারও আগে ’৭০-এর নির্বাচন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ ও অবিস্মরণীয় জয়লাভ। সেই ঐতিহাসিক ভোটের অধিকার ও অর্জন যেন বাঙালীর এক সংগ্রামী দলিল। ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের অভাবনীয় বিজয় ছাড়া এমন পরিকল্পিত আর আদর্শিক চেতনার অগ্রযাত্রা সমকালীন বাঙালীর ইতিহাসের যুগান্তকারী পালাক্রম। যার পটভূমি তৈরি হয় সেই ’৪৭-এর অনাকাক্সিক্ষত দেশ কর্তনের মধ্য দিয়ে। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের এক অপকৌশলের শিকার হয়ে নতুন মোড়কে পুরনো কাঠামোর অনাকাক্সিক্ষত উত্থান। বিশিষ্টজনেরা অভিমত ব্যক্ত করেন, ব্রিটিশ উপনিবেশের করাল গ্রাস থেকে পাকিস্তানী নব্য উপনিবেশের নিষ্ঠুর চক্রান্তে আবর্তিত হওয়া। তার দাম যে কিভাবে চুকাতে হয়েছে ২৪ বছরের পাকিস্তানী সামরিক জান্তার শাসন-শোষণের অনভিপ্রেত পথ পরিক্রমায়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ সিংহভাগ মানুষের জীবনে কোন ধরনের স্বস্তি, অধিকার কিংবা স্বাধীনতা দিতেও ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। রাষ্ট্রভাষা কী হবে তেমন সঙ্কটে পড়তেও সময় লাগে না। জনগোষ্ঠীর দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ অনেকখানি এগিয়ে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায়। সঙ্গত কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া ছিল তৎকালীন শাসকশ্রেণীর দায়বদ্ধতা। পাশাপাশি উর্দুকেও রাষ্ট্র্রভাষার স্বীকৃতি দিতে কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানের জনক নামে চিহ্নিত কায়েদে আযম যা করলেন সেটা বাঙালীর আত্মপরিচয়ের ওপর আগ্রাসী আক্রমণ। ঐতিহ্যিক বাংলাভাষা যা কিনা তৎকালীন পাকিস্তানের সিংহভাগ মানুষের মুখের ভাষা তাকে আমলে না নিয়ে উর্দুকেই ঘোষণা দিলেন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। সেই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ভাগের অব্যবহিত পরেই। সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাষার কারণে দেশীয় সাংস্কৃতিক বলয়ের ঐতিহ্য রক্ষায় সংগ্রাম-আন্দোলন। সেদিনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে তার স্বভাবসুলভ তর্জনী উঁচিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। সেই যে শুরু করলেন জীবনের শেষদিন অবধি কোন বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে আদর্শিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে যা যা প্রয়োজন ছিল সবটাই করেছেন নির্বিঘেœ, নির্দ্বিধায়। দীপ্ত মনোবলে আপোসহীনতার দৃঢ় শক্তিতে আপামর বাঙালীর মঙ্গল আর কল্যাণে সামান্যতম চ্যুত হতে তাকে কখনও দেখা যায়নি। সবার আগে অন্তর্নিহিত বোধে লালন করেছিলেন দেশপ্রেমের অনমনীয় চেতনা। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় বাঙালীর আত্মপরিচয়ের যে বীজ অঙ্কুরিত হয় ’৬০ এর দশকে তা বিরাট বটবৃক্ষে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্যকে অবারিত এবং অনিবার্য করে তুলেছিল। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের পরিবর্তে বিশ্ব কবিকে বিসর্জন দেয়ার যে অশুভ পাঁয়তারা শুরু করে তা সাংস্কৃতিক চেতনায় মিলিত শক্তিতে প্রতিহত করতে কঠোর কর্মসূচী প্রদান করা হয়। তারই সংগ্রামী প্রেক্ষাপটে তৈরি হয় ‘ছায়ানটে’র মতো বৃহত্তর শিল্প সংস্কৃতি চর্চার নতুন সংগঠন। এরপর ’৬২ সালের ছয়দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরির যে আকাক্সিক্ষত বীজ বপিত হয় সে লক্ষ্যমাত্রায় ’৭০-এর নির্বাচনও সারা বাংলায় তার যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। এ সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল শুধু নজর কাড়াই নয় একেবারে শীর্ষস্থানে। কারণ ততদিনে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার অসাধারণ বাগ্মিতা, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং অনমনীয় দেশপ্রেমের শুদ্ধ চেতনায় সর্বোচ্চ নেতৃত্বে চলে আসতে খুব বেশি দেরি করেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে বাঙালীর এমন গৌরবোজ্জ্বল নেতৃত্বকে ক্ষমতা দিতে পাকিস্তানী সরকার বৈধভাবে বাধ্য ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের শুরু থেকে আরম্ভ হলো ষড়যন্ত্রের জাল বুনন। যাতে পুরো বাংলাদেশ আটকে থাকে। শুধু তাই নয় এই সংগ্রামী, আকর্ষণীয় নেতৃত্বকেও কোণঠাসা করার চেষ্টা চালায়। সশস্ত্র পাকিস্তানী সরকার মানসিকভাবে দৌর্বল্য প্রদর্শন করতে গিয়ে টালবাহানায় ক্ষমতা হস্তান্তরকে অপরিণামদর্শিতার পর্যায়েও নিয়ে যেতে সব ধরনের কূটকৌশল প্রয়োগ করে। শেষ অবধি পূর্ণাঙ্গ অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানালে মার্চ মাসে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ, আন্দোলন, সংগ্রামী পথযাত্রা। সামরিক বাহিনী বেষ্টিত সারা বাংলার প্রতিদিনের পথপরিক্রমা ছিল রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত এবং প্রাণ সংহারের মতো অভাবনীয় দুর্যোগ। তেমন দুঃসহ অভিগমনকে অতিক্রম করতে বঙ্গবন্ধুকেও নিতে হয়েছিল তাৎক্ষণিক এবং উপস্থিত অনিবার্য কর্মপ্রক্রিয়া। যার যাত্রা শুরু হয় ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে। যে ভাষণ একদিন বাঙালীর মুক্তির চেতনার অনিবার্য শৌর্য ছিল কাল থেকে কালান্তরেÑ আজ তা বিশ্বসভায় সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। অসহায়, নিপীড়িত, পরাধীন জাতির অবিস্মরণীয় মুক্তির বার্তায় আজ ইউনেস্কো ও তার ৭টি অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দলিলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সসম্মানে অভিষিক্ত করে বিশ্ব সভায় তার মর্যাদাকে চিরস্থায়ী করে দেয়। এমন বরেণ্য সম্মানের অধিকারী যিনি তাকেই এক সময় দেশীয় কুচক্রী মহল পরিবারসহ নৃশংসভাবে খুন করে। দুই কন্যাÑ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, তাঁদের বেঁচে যাওয়ার পেছনে অদৃশ্য মহাশক্তির নির্দেশে বাংলার মঙ্গল এবং কল্যাণের শুভ বার্তা অবশ্যই ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বঙ্গভূমির মাটিতে পা রাখলেন। তেমন দৃশ্যও স্মরণকালের ইতিহাসের এক অনন্য বরণীয় মাঙ্গলিক আলেখ্য। আবহমান বাংলার চিরস্থায়ী নেতৃত্বে অভিষিক্ত হওয়ার এই কৃতী মহামানব, দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু মুক্ত ভূমিতে জয়মাল্য বরণ করে নিজেকে আরও একবার ঐতিহ্যিক পরিম-লে সমর্পণ করলেন। তেমন স্বর্ণ ইতিহাস বাঙালীর গৌরবোজ্জ্বল পথপরিক্রমার অবিস্মরণীয় অহঙ্কার। এরপর অপেক্ষা করছিল আরও দুঃসময়। অস্তিত্ব হারানোর মতো সর্বনাশা বিপর্যয়। বঙ্গবন্ধু তৈরি হচ্ছিলেন স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তার যুগান্তকারী চৈতন্যে আর পর্বতপ্রমাণ দেশাত্মবোধের আদর্শে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের পালাক্রমের মাঝখানেই সংঘটিত হলো আবারও সাড়া জাগানো, দেশ কাঁপানো আরও এক মধ্যযুগীয় বর্বরতা। স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূদের নিয়ে পাশবিক নৃশংসতায় চিরতরে তাঁর আকাক্সিক্ষত বাংলাদেশ থেকে দূরে, বহু দূরে চলে গেলেন। সেখান থেকে কারোর ফিরে আসা একেবারেই অসম্ভব। স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র, চক্রান্তে যেভাবে লালসবুজের পতাকা লুণ্ঠিত হলো সেখানে যথার্থ বাংলাদেশে ফিরে আসতে জনগোষ্ঠীকে ২১ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকতে হয়েছিল। বিজয়ের মাস এলেই এমনসব স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যিক ও সংগ্রামের পথপরিক্রমাও অনিবার্যভাবে সামনে চলে আসে। স্বপ্নের আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধু কন্যা পিতার আদর্শকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। লেখক : সাংবাদিক
×