ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধান শিক্ষকের নির্যাতনের ভয়ে বিদ্যালয় ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা ॥ তদন্ত কমিটি গঠন

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রধান শিক্ষকের নির্যাতনের ভয়ে বিদ্যালয় ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা ॥ তদন্ত কমিটি গঠন

নিজস্ব সংবাদদাতা, শরীয়তপুর ॥ শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ৩৩নং চরচান্দা মুন্সিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আসাদের বিরুদ্ধে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতনসহ শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠেছে। ফলে প্রধান শিক্ষকের ভয়ে ওই বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও বাধ্যতামূলক কোচিং বাণিজ্য, পরীক্ষার ফি ও প্রশংসাপত্রের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়, নতুন ছাত্র ভর্তি ও নতুন বই বিতরণের সময় টাকা আদায়, শিক্ষার্থীদের উপ-বৃত্তির টাকা আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ ওঠেছে উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আসাদের বিরুদ্ধে। উক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ১৩টি অনিয়মের অভিযোগ এনে খোদ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ স্বাক্ষর করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে এ বিষয়ে এশটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। প্রধান শিক্ষকের অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যালয়ের অন্যান্য সহকারী শিক্ষকবৃন্দ। লিখিত অভিযোগপত্র, এসএমসি সভাপতি মো. ফারুক মুন্সী, স্থানীয় মো. রোকন উদ্দিন, আবু বকর, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আসাদ নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না। প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেন। বছরের শুরুতে নতুন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি ও সরকারি বই বিতরণের জন্য ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা গস্খহণ করেন এবং শিক্ষার্থীদের উপ-বৃত্তির টাকা থেকে কর্তণ করে আত্মসাৎ করে থাকেন। বিদ্যালয় চলাকালিন সময়ে কোচিং করতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন। পরীক্ষা জন্য ও সমাপনী পরীক্ষায় পাসের পর শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র প্রদান করার সময় ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা গ্রহন করেন। শিক্ষার্থীরা টাকা না দিলে তার উপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতন ও কু-প্রস্তাব করেন প্রধান শিক্ষক আলী আসাদ। এই সকল বিষয়ে শিক্ষার্থীরা মুখ খুললে তাদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শারীরিক নির্যাতন চালান প্রধান শিক্ষক। অভিযোগের বিষয়টি সত্যতা স্বীকার করেছেন ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াছমিন ও সরোয়ার। তারা বলেন, প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে তারা সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক কোচিং করান। কোচিংয়ের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩শ’ টাকা করে আদায় করা হয় যা প্রধান শিক্ষক আত্মসাৎ করেন। বিদ্যালয় ভবনের পাশের বাড়ির আমির হোসেন কাজীর স্ত্রী রেনু বেগম বলেন, আমি রান্ন ঘরে বসে প্রধান শিক্ষকের আচার-আচরণ সবই শুনি। ফোর-ফাইভে পড়–য়া মেয়েদের সাথে খুব খাবার আচরণ করেন তিনি। খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করেন আর এমনভাবে শিক্ষার্থীদের পিটায় তখন তারা মা-বাবা বলে কান্নাকাটি করে তারপরও মেয়েদের ছাড়ে না। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ জানায়, প্রধান শিক্ষক আলী আসাদ বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক কোচিং করায়, পরীক্ষার ফিস বেশী নেয়, ভর্তির ফি নেয়। আমরা অনেক সময় স্যারের চাহিদা মত টাকা দিতে পারি না। তখন সে বাচ্চাদের সাথে খারাপ আচরণ করে এবং শারীরিক নির্যাতন চালায়। বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহাগী ও হালিমা জানায়, প্রধান শিক্ষক তাদের লাইব্রেরীতে ডেকে নিয়ে টাকা দিতে চায় আর খারাপ কথা বলে, কু-প্রস্তাব দেয়, তার কথা না শুনলে খুব মারে। একই ক্লাসের রাহুল, মারুফ, সামিরসহ অনেকে জানায়, প্রধান শিক্ষকের পিটানোর ভয়ে তারা বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এসএমসি সভাপতি মো. ফারুক আলম মুন্সী বলেন, এই প্রধান শিক্ষক অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে। তার অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসতে ভয় পায়। সরকারি স্কুলে ক্লাস চলাকালে টাকার বিনিময়ে কোচিং করানো, বইয়ের বিনিময়ে টাকা ও ভর্তি ফি নেয়া নিয়মে পরিণত হয়েছে। এরকম অনিয়ম অন্য কোথাও নাই। সে আমার স্বাক্ষর জাল করেও বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ করেছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছি। দেখি তারা কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও এসএমসি’র সহ-সভাপতি মো. কবির মোল্যা বলেন, অভিযোগের বিষয় সম্পূর্ণ সত্য। আমার কাছে এমন অভিযোগ নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আসেন। ইতোপূর্বে আমি একাধিক সালিশ করেছি। এ প্রধান শিক্ষক কোন সংশোধন হয়নি। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আলী আসাদ বলেন, বিদ্যায়ের সহকারী শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াছমিন বিদ্যালয়টিকে বাড়ির মত করে ব্যবহার করেন। আমি বাধা দেয়ায় সেই শিক্ষিকা এলাকাবাসী ও কমিটির লোকজন নিয়ে আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। আমি কোন কোচিং বানিজ্য, ভর্তি ফি বা বইয়ের বিনিময়ে টাকা নেই না। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্যদের স্বাক্ষরিত একটা অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে ওই শিক্ষক অভিযুক্ত হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×