ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বন্ধ হবে না ॥ দুদক চেয়ারম্যান

প্রকাশিত: ১০:১৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

  চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বন্ধ হবে না ॥ দুদক চেয়ারম্যান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুর্নীতি করে আইনী প্রক্রিয়া অবলম্বন ছাড়া তদ্বির করে বা কাউকে প্রভাবিত করে মামলা থেকে রেহাই পাবেন এমনটা মনে না করতে দেশের সকল দুর্নীতিবাজদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন দুদকের বারান্দায় এসে আজ না হয় কাল ঘুরে যেতে হবে এমন প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান। রবিবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স এগেইন্সট করাপশান (র‌্যাক) এর উদ্যোগে প্রথমবারের মতো আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সূচনাা বক্তব্য রাখেন র‌্যাকের সভাপতি মোর্শেদ নোমান, সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আদিত্য আরাফাত। এছাড়া দুদক কমিশনার আমিনুল ইসলাম ও দুদকের উর্ধতন কর্মকর্তাগণসহ র‌্যাকের সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চাই ও একই সঙ্গে নিজেদের কাজের জবাবদিহিতাও চাই। দেশে দুর্নীতি আগের চেয়ে কমেছে। তবে অভিযোগ বেড়েছে। দুদকের ব্যাপারে জনগণের আস্থা একটু হলেও বেড়েছে বিধায় দুদকে অভিযোগ বেড়েছে বলেন তিনি। সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, অনেকেই বলছেন এ অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দুদক কাজ করছে। এরইমধ্যে ১৮৭ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দুদক যাদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে, আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া তাদের বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং অভিযুক্তদের আনন্দে থাকার কোন সুযোগ নেই। দুর্নীতি যেই করুন না কেন, তাকে দুদকের বারান্দায় আসতে হবে। চেয়ারম্যান বলেন, বিদেশে অর্থপাচারের সঙ্গে কারা জড়িত তা আমরা লক্ষ্য করছি। আমরা মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে শতভাগ মামলায় সাজা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছি। তবে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত সরকারের অন্যন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাচারের ঘটনা ঠেকাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মামলা না করলে, দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে কি করা যায় তা মনিটরিং করা হচ্ছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুসম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, বেসিক ব্যাংকের মামলার চার্জশীট অনুমোদন চেয়ে কর্মকর্তারা আমাদের প্রতিবেদন দিয়েছিল, কিন্তু চার্জশীটে টাকার শেষ গন্তব্য বের করা না যাওয়ায় অনুমোদন দেয়া হয়নি। চেয়ারম্যান বলেন, চলমান শুদ্ধি অভিযানে অনেক রাঘববোয়ালের নাম এসেছে। এ পর্যন্ত যাদের নাম আমরা পেয়েছি ও তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছি। কিন্তু এর মধ্যে ১৪ জনকে ডাকা হয়েছে বাকিদের নিয়ে কাজ চলছে। কারণ বৈধ অর্থ নিয়ে জুয়া খেলা বা ক্যাসিনোতে এত খরচের সুযোগ নেই। ক্যাসিনো বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কেউই ছাড় পবে না। দুদকের কছে যে তথ্য আছে তাতে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কোনক্রমেই বন্ধ হবে না। কারণ এর কোন সুযোগই দুদকের নেই। অভিযান চলবে। ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদকে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। অভিযোগ বাড়ার কারণ জন আস্থা বেড়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, টিআইবির ‘স্যাম্পল’ কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। টিআইবির সূচক একটা পারসেপশন। পারসপেশন তৈরি সংবাদপত্রের মাধ্যমে যা কোনক্রমেই ঠিক নয়। দুর্নীতির প্রাথমিক তথ্যও হাতে থাকতে হবে। ইকবাল মাহমুদ বলেন, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির কিছু টাকা মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গেছে। এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে তথ্য পাওয়া গেলে মামলাগুলোর চার্জশীটের অনুমোদন দেয়া হবে। বেসিক ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে কি না তা জানতে কয়েকটি দেশে এমএলআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্টেন্ট রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছে। তিনি বেনামী চিঠি সম্পর্কে বলেন, দুর্নীতির তথ্য দিন, নাম না থাকলেও হবে। কারণ চলতি বছরে দুদকে কেবল লিখিত অভিযোগই এসেছে ২২ হাজার ২৩৬টি। যার মধ্যে প্রায় ৩ হাজারের কিছু বেশি অভিযোগ যাচাই পর্যায়ে রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, হাসপাতাল থেকে স¤্রাট ছাড়া পেলেই, তাকে আবার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে বলেন, এ নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা কাজ করছে। তারা কোন ব্যবসায়ীর অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। নিজেদের বেশ কিছু সফলতা দাবি করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, গত অক্টোবর পর্যন্ত দুদকের সবকিছু উর্ধমুখী। এটার কারণ জনআস্থা। দুদকে অভিযোগ করলে কিছু একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে-এ ধারণা আমরা তৈরি করতে পেরেছি। এছাড়া ফাঁদ মামলা বেড়েছে। যারা সরকারী কর্মকর্তা, জনগণের টাকায় বেতন পান কিন্তু কাক্সিক্ষত সেবাটা দিচ্ছেন না, দুর্নীতির প্রস্তাব গ্রহণ করছেন এবং ঘুষ নিচ্ছেন, তারা ফাঁদ মামলায় পড়ছেন। ঘুষ বন্ধ হয়নি, তবে ঘুষের মাত্রা কমেছে এ ফাঁদ মামলার কারণে। গণশুনানি সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অনেকগুলো গণশুনানি হয়েছে। গণশুনানিতে আমরা নিজস্ব রিসোর্স ব্যবহার করেছি। গণশুনানির কারণে জনগণের মধ্যে অভিযোগ করার যে অধিকার, ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়ার যে অধিকার সেটা বেড়েছে। আমরা মনে করি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা গণশুনানিতে অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি হয়েছে। জনগণের মধ্যে সেবা পৌঁছে দেয়ার বিষয়টিও তারা অনুধাবন করতে পারছেন। ফলে দুর্নীতিও অনেক কমেছে। এছাড়া অনেক সমস্যার সমাধানও গণশুনানিতে আমরা নিষ্পত্তি করেছি। ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাচ্ছি, কাজ করছি। আগে সংবাদপত্রেই আমাদের নির্ভরতা ছিল। কিন্তু এখন ফেসবুক, ই-মেইল, চিঠি, পত্রিকা ও টিভির মাধ্যমেও অভিযোগ পাচ্ছি। সবকিছু মিলে সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের সক্ষমতাও বেড়েছে। দুর্বল শক্তিশালী সবমিলে মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। যদিও মামলায় শাস্তির পরিমাপ না বাড়লেও কমেনি। দুদক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করতে কাজ করছে। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা ১৮০ দিনের মধ্যেই সকল কাজ শেষ করতে পারছি না। তিনি বলেন, একান্তই যেসব মামলার ক্ষেত্রে পারছি না, সেখানে শুধু সময় নিচ্ছি। আমাদের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কম। আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছেড়েছি। আশা করছি, দ্রুতই এ ঘাটতিও কাটাতে পারব। জনবলের অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে নয়, বিদেশেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হংকং, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ অনেকে দেশে আমাদের প্রশিক্ষণের টিম গেছে। তিনি বলেন, আমরা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা রাখিনি। অভিযোগ গ্রহণের বিষয়টি চলমান। ইচ্ছা করলেই কেউ অভিযোগ গ্রহণ করতে পারেন না, আবার ইচ্ছা করলেই ফেলে দিতে পারেন না। আগে এটা ছিল না। এমনও হয়েছে আগে অনেক অভিযোগেও হদিসও মিলত না। এখন সব হদিস পাবেন। তথ্যগত সহায়তাও আমরা দিচ্ছি যথাযথ প্রক্রিয়ায়। তিনি আরও বলেন, ‘সাক্ষীর সুরক্ষার বিষয়টিও দুদক গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কর্মকর্তাদের বলেছি, সুরক্ষা দিতে। মানি লন্ডারিং একটা বড় বিষয়। আমরা যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা ৩৪টি মামলার চার্জশীট দিয়েছি, শতভাগ শাস্তি হয়েছে। ইকবাল মাহমুদ বলেন,আইনের ভাষায় বা কমিশনের ভাষায় ‘দায়মুক্তি’ বলে কোন শব্দ নেই। আমরা অভিযোগ অনুসন্ধানের পর্যায়ে কেউ যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ রয়েছি। কারণ, অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষ। তার আগে কারও সামাজিক সম্মান ক্ষুণœ করা যায় না। দায়মুক্তি না বলে অভিযোগের সারবত্তা নাই বলাই ভাল বলেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমরা আগামী প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায়-মননে একটা দুর্নীতিবিরোধী ছাপ ফেলানোর জোর চেষ্টা করছি। সেজন্য আমরা ২৭ হাজারের বেশি সততা সংঘ করেছি। সততা চর্চা করার জন্য চার হাজার সততা স্টোর করা হয়েছে। তিনি বলেন, গত সাড়ে তিন বছরে আমাদের একটা সফলতা হচ্ছে যে, আমরা একটা মেসেজ দিতে পেরেছি যে, যে যত বড় পাওয়ারফুল হোক না কেন, দুর্নীতি করলে দুদকে আসতে হবে। এটা আমরা নিশ্চিত করেছি।
×