ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব মোকাবেলা

ভবিষ্যতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে নৌকাস্কুল

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

ভবিষ্যতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে নৌকাস্কুল

সমুদ্র হক ॥ ভয়াবহ বন্যা ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অস্তিত্বের লড়াই করে টিকে থাকে মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ শেষে নতুন করে জীবন শুরু করে। মানুষের এই আত্মবিশ্বাস চলনবিল পাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে রেজোয়ানকে আকৃষ্ট করে। বিলঝিল ও নদীপাড়ের গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াশোনা যাতে বিঘিœত না হয় সেই ভাবনা থেকে বিলপাড়ের ছেলে তরুণ প্রকৌশলী রেজোয়ানকে উদ্বুদ্ধ করে। গড়ে তোলেন নৌকাস্কুল, বর্তমানে শিক্ষা বিস্তার যা কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেজোয়ানের এই নৌকাস্কুল মডেল হয়ে চালু হয়েছে। বুয়েট থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় ডিগ্রী নেয়ার পর ধনকুবের বিল গেটসের মেলিন্ডা ফাউন্ডেশন এই নৌকাস্কুল বাস্তবায়ন করেছে। রেজোয়ান তার স্কলারশিপের ৫শ’ ডলার দিয়ে তৈরি করেন এই নৌকাস্কুল, ছড়িয়ে দেন ওয়েবসাইটে। রেজোয়ানের নৌকাস্কুলে ৩০ শিশু পাঠ নিতে পারে। জাতিসংঘের ফান্ডস এ্যান্ড প্রোগ্রামসের ইউনিসেফ, ইউএনইপি, ইউএনডিপির উদ্ভাবন শাখায় স্বীকৃতি পেয়েছে নিভৃতপল্লীর রেজোয়ান। গত নবেম্বরে যুক্তরাজ্যের প্রকাশনা সংস্থা ‘নজিক্রো’ বাংলাদেশের নৌকাস্কুল উদ্ভাবক রেজোয়ানকে ‘আর্থ হিরো’র মর্যাদা দিয়েছে। ‘নজিক্রোর লিলি দাইউ রচিত আর্থ হিরোজ টোয়েন্টি ইনস্পায়ারিং স্টোরিজ অব পিপল সেভিং আওয়ার ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে রেজোয়ানকে ‘আর্থ হিরো’ স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি ২০ জনের মধ্যে ক্লাইমেট চেঞ্চ বুক ফর ইয়ং এডাল্টস ক্যাটাগরিতে ‘আর্থ হিরো’। বইটির লেখক লিলি বলেছেন, বাংলাদেশের রেজোয়ানের কাছ থেকে ভবিষ্যতের লড়াইয়ে শিক্ষা নেবে পৃথিবী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, স্লোভানিয়া, ভিয়েতনামের কম্বোডিয়া, নাইজিরিয়া, জাম্বিয়া, ফিলিপিন্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই মডেল গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেছে। ওসব দেশের পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে এই নৌকাস্কুল। বর্তমানে রেজোয়ানের নৌকাস্কুলের সংখ্যা এক শ’র বেশি। চলনবিলের তিন জেলায় বিশাল জলরাশির মধ্যে ভেসে বেড়ায়। ভেড়ে ঘাটে ঘাটে। ২০০২ সালে এই নৌকাস্কুল প্রথম চালু হয়। খবর পৌঁছে যায় বিলগেটসের মেরিন্ডা ফাউন্ডেশনে। অনুদান মেলে ৫ হাজার ডলার। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার প্রত্যন্ত সিঁধুলাই গ্রামের ছেলে রেজোয়ান ৫৫ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট চওড়ার নৌকা তৈরি করেন। এর ওপর বাঁশবেতের ছাউনি দেন। মেঝের মতো শক্ত কাঠের পাটাতন, ঘরের মতো দরোজা-জানালা বানিয়ে নৌকার মধ্যে বানান পাঠদানকক্ষ। এখানে ত্রিশ শিশু একসঙ্গে শিক্ষা নিতে পারে। নৌকাস্কুল পরিচালনার জন্য রেজোয়ান একটি টিম তৈরি করেন। এরাই এখন বিশাল জলরাশির চলনবিলে চালাচ্ছেন নৌকাস্কুল। নৌকাস্কুল অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক পাঠের একটি ভাসমান স্কুল। বিল ও নদী তীরের গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা যখন দূরের কোন স্কুলে যেতে পারে না তখন শিক্ষা বিঘিœত হয়। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির পরও নানা কারণে ঝরে পড়ে। প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে শিশুদের কিছু অংশ এখনও স্কুলমুখী হতে পারেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই দেশে বন্যার সময় অনেক প্রাথমিক স্কুলে পানি ওঠে। পাঠ বন্ধ থাকে অনেকটা সময়। মৌসুমি বন্যায় দেশের এক পঞ্চমাংশ এলাকা ডুবে যায়। বড় বন্যায় তিন ভাগের দুই ভাগ তলিয়ে থাকে। শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম সাময়িক স্থগিত হয়ে পড়ে। এ সময় অন্তত ২০ লাখ শিশুর লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। বন্যার সময় বিলের কোন গ্রামের শিশুরা যেন কোনভাবেই পাঠ থেকে দূরে না থাকে সেই লক্ষ্যেই বিলপাড়ের প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজোয়ান বানান নৌকাস্কুল। বনেদি পরিবারের ছেলে বেড়ে উঠেছেন চলনবিলের জলরাশির মধ্যে। বৃষ্টি বর্ষায় স্কুলে যেতে না পারার অভিজ্ঞতা তার আছে। নৌকা ছাড়া সে সময় যাতায়াতের কোন পথ ছিল না। রেজোয়ানের শিশুমনে গেঁথে যায় এই অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন তিনি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পর ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। ১৯৯৮ সালে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক করেন। বছর না পেরোতেই দেখা যায় এই স্কুলের উপস্থিতির হার বেশি। নৌকাস্কুলের সুযোগ সুবিধা দিনে দিনে বাড়ানো হয়। নৌকাস্কুলের ভেতরে বাতির জন্য নৌকার ছাদে বসানো হয় সোলার প্যানেল। বিদ্যুত বাতিতে রাতেও পাঠদান চলে। ছোটদের পাশাপাশি বড়দের কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সংযুক্ত করা হয় পাঠাগার। ডিভাইসে সাজানো হয় তথ্য প্রযুক্তির কম্পিউটার ল্যাব। গ্রামের অনেক শিক্ষিত লোক এই ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’র অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। এলাকায় কোন শিশু আর শিক্ষাবিমুখ থাকছে না। চলনবিল ছাড়াও আশপাশের বিল ও নদী তীরের গ্রামে গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের এমন সুযোগ করে দিয়েছে এই নৌকাস্কুল। চলনবিল বলতেই আগে বলা হতো পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। আজ সেই জনগোষ্ঠী পরিবর্তনের ধারায় যোগ দিয়ে স্বর্ণদুয়ার খুলছে। স্থপতি রেজোয়ান যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের একজন ফেলো। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রামের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালে শ্রী সত্যসাঁই এ্যাওয়ার্ড ফর ডিজাইন এক্সিলেন্স, ’১৭ সালে কেরিস্টোন ডিজাইন পুরস্কার পেয়েছেন। রেজোয়ানের কীর্তি মার্কিন স্মিথসোনিয়ানস, কুপারহিউইট ন্যাশনাল ডিজাইন মিউজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের স্থাপত্য বিষয়ক বেঙ্গল স্ট্রিমে প্রদর্শিত হয়েছে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকায় সারাবছর মানসম্মত শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করতে নৌকা স্কুল উদ্ভাবনের পর ১৭ বছর ধরে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে, হচ্ছে আধুনিকায়ন। রেজোয়ান জানান বাংলাদেশসহ বিশ্বের বন্যাকবলিত অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে। এই সঙ্কট মোকাবেলায় নৌকাস্কুল ছাড়াও নৌকার মধ্যে ভাসমান কৃষি খামার, সবজি বাগান গড়ে তোলা সম্ভব। নৌকাস্কুলকে আরও উন্নত করে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া যায়। এমন স্বপ্ন দেখছেন রেজোয়ান। তার এই নৌকাস্কুলের ওপর ‘ইজি লাইক ওয়াটার’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। যা বিশ্বের দেশে দেশে প্রদর্শিত হয়ে এই বিশাল অর্জন বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষ সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে সেই চেষ্টা করছেন রেজোয়ান। তিনি নিজ গ্রামে সিঁধুলাইয়ে স্বেচ্ছাসেবী নামে একটি অলাভজনক সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
×