ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

ফাতিহায়ে ইয়াযদহমের তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

 ফাতিহায়ে ইয়াযদহমের তাৎপর্য

গওসুল আজম আবু মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির ওফাত দিবস পালিত হয় ফাতিহায়ে ইয়ায্দহম নামে। এই দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। তার কারণ- এই দিবসটি যে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানেই কেবল পালিত হয় তা কিন্তু নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেও বিভিন্ন নামে পালিত হয়। ইলমে তাসাওউফে যে সমস্ত তরিকা রয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তরিকা হিসেবে বিবেচিত হয় গওসুল আজম (রহ) কর্তৃক বিন্যাসকৃত কাদিরীয়া তরিকা এবং এই তরিকার বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভাবে, যা অন্য সব তরিকার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যে কারণে গওসুল আজমের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়েছে। কাদিরীয়া তরিকা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু খানকা গড়ে উঠেছে। ফাতিহায়ে ইয়ায্দহম অর্থাৎ ১১-এর ফাতিহা। ইয়ায্দহম ফার্সী শব্দ। এর অর্থ ১১। ৫৬১ হিজরী মুতাবিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস সানী সোমবার রাতের শেষ প্রহরে তিনি ইন্তেকাল করেন। যে কারণে এই ১১ বলতে ১১ রবিউস সানীকেই বোঝানো হয় এবং এই ১১ এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে যায় যে, অনেক খানকা শরীফে এগারো শরীফ বা গিয়ারা শরীফও অনুষ্ঠিত হয়। হযরত গওসুল আজম আবু মুহম্মদ মহীউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন যখন গ্রীক ও ভিনধর্মী দর্শন মুসলিম শিক্ষা ও চিন্তা জগতে দারুণভাবে বিভ্রান্তির কালো থাবা বিস্তার করে ফেলছিল। শিরক, কুফর ও বিদআতের খপ্পর থেকে, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের কব্জা থেকে, তওহীদ ও রিসালাতের পথ থেকে ছিটকে পড়া উম্মতে মুহম্মদীকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য তাঁর মতো একজন মহান সংস্কারকের, দীনকে পুনর্জীবিতকারী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিল। গওসুল আজম রহমাতুল্লাহি আলায়হির আব্বা সৈয়দ আবু সালিহ মূসা দস্তজংগী ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত সূফী এবং আম্মাজানও ছিলেন মশহুর হাফিজা ও আবিদা। শৈশবেই আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) পিতৃহারা হন। অতি শৈশবেই তিনি কুরআন শরীফ হিফ্জ করেন। বিভিন্ন বর্ণনা মতে তিনি মাতৃগর্ভে থাকাকালেই ১৮ পারা কুরআন শরীফ হিফ্জ থাকার কারণে কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। এটা প্রকাশ পায় তখন যখন ৪ বছর বয়সে তাঁকে আম্মাজান একজন কারীর কাছে কুরআন মজীদ শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। কিন্তু শিক্ষক ও আশপাশের লোকজন যখন দেখলেন যে, অতটুকু শিশু বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম বলার সঙ্গে সঙ্গে একনাগাড়ে সূরা ফাতিহা থেকে ১৮ পারা পর্যন্ত মুখস্থ তিলাওয়াত করছে তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহু মানুষ তাঁকে দেখবার জন্য ভিড় করলেন এবং সবাই বলাবলি করতে লাগল, এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, নিশ্চয়ই এ শিশু একজন মশহুর আল্লাহর ওলি হবেন। তিনি মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক দীনি শিক্ষা গ্রহণ করে জিলান নগরীর এক মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। তাঁর আম্মা ছেলেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদ শরীফ পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাগদাদ শরীফ তখন মুসলিম খিলাফতের রাজধানী। বাগদাদের নিযামীয়া মাদ্রাসা ছিল তদানীন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। একদিন বাগদাদগামী একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে তাঁর আম্মা তাঁকে বাগদাদ শরীফ পাঠিয়ে দিলেন। পুত্রকে বিদায় করবার সময় তিনি তাঁর জামার আস্তিনের বগলের ভেতরে ৪০টি দীনার বা স্বর্ণমুদ্রা সেলাই করে দিলেন পুত্রের শিক্ষা গ্রহণের ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং পুত্রকে বললেন : ঠিকমতো লেখাপড়া করবে আর সদা সত্য কথা বলবে। আম্মাকে সালাম করে তিনি কাফেলার সঙ্গে বাগদাদ শরীফের উদ্দেশে রওনা হলেন। কিন্তু পথিমধ্যে এই কাফেলা একটি ডাকাত দল দ্বারা আক্রান্ত হলো। ডাকাতরা সব লুট করার পর কিশোর আবদুল কাদির (রহ)- কে দেখে বলল, হে বালক তোমার কাছে কি কিছু আছে? তিনি অকপটে বললেন : আমার আস্তিনের ভেতর ৪০টি দীনার আছে। ডাকাত সর্দার তাঁর বগলের নিচে আস্তিনের ভেতর থেকে ৪০টি দীনার উদ্ধার করে বলল : বোকা বালক! তুমি যদি না বলতে তাহলে তো আমরা টেরই পেতাম না যে, তোমার কাছে এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা আছে। তখন কিশোর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়াহি বললেন : আমার আম্মাজান বলে দিয়েছেন, বাবা, সদা সত্য কথা বলবে। তাই আমি মিথ্যা বলি না। এ কথা শুনে ডাকাতদের মনে সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট পরিবর্তন সঞ্চারিত হলো। তারা তওবা করে ডাকাতি করা পরিত্যাগ করল। এটা যে তাঁর এক অনন্য কারামাত ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাগদাদ শরীফ এসে তিনি সেকালের শ্রেষ্ঠ আলিম ফকীহ্ ও মুহাদ্দীসদের সান্নিধ্যে থেকে ইলমে জাহিরের তাবত বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করলেন। তিনি ইলমে তাসাওউফে সর্বোচ্চ কামালত হাসিল করলেন। তিনি ইলমে তাসাওউফ তথা শরীআত, তরীকত, হকীকত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে বিন্যাসিত ইসলামের এই অনন্য বিজ্ঞানকে আরও সহজে চর্চার সুবিধার্থে এক আলোকিত ধারার পদ্ধতি বিন্যাস করেন। এটা অচিরেই কাদিরীয়া তরিকা নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ইল্মে তাসাওউফের আলখেল্লা পরা তাঁর কালের সমস্ত বাতিল র্ফিকাগুলোকে চিহ্নিত করেন। তিনি সেই সময়কার ৭২টি বাতিল ফিরকা চিহ্নিত করে তাদের সান্নিধ্যে না যাবার জন্য আহ্বান জানান। তিনি কি কি কারণে ঐ সমস্ত ফিরকা বাতিল তাও উল্লেখ করে পুস্তক লিখে তা জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। তিনি ইল্্মে তাসাওউফের সংজ্ঞা নির্ণয় করে বলেন যে, ইল্্মে তাসাওউফ লিখতে তা, সোয়াদ, ওয়াও, ফা- এই চারটি হরফ ব্যবহৃত হয়। এই চারটি হরফের এক একটি হরফ মূলত এক একটি অর্থবহ শব্দের আদ্যাক্ষর। যেমন : ‘তা’ অক্ষরটি হচ্ছে তওবা শব্দের আদ্যাক্ষর। তওবা দুই প্রকারের আর তা হচ্ছে জাহিরী ও বাতিনী। তাসাওউফ লিখতে দ্বিতীয় যে হরফ লাগে তা হচ্ছে সোয়াদ। এই সোয়াদ হচ্ছে সাফা শব্দের আদ্যাক্ষর। এটাও দুই প্রকারের আর তা হচ্ছে বাহ্যিকভাবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করা এবং আন্তরিকভাবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করা। তৃতীয় হরফ ওয়াও হচ্ছে বিলায়েত শব্দের আদ্যাক্ষর। বিলায়েত হচ্ছে আল্লাহর ওলিগণের জন্য নির্ধারিত বিশেষ মর্যাদার রাজত্ব যাকে ওলিত্ব বলা হয়। চতুর্থ শব্দ ফা হচ্ছে ফানা শব্দের আদ্যাক্ষর। এটা আল্লাহ মা’রিফাতে ধন্য আরিফা বিল্লাহ্গণের চূড়ান্ত অবস্থা। এই পর্যায়ে উন্নীত আল্লাহর ওলিগণ আল্লাহ্ প্রেমে সামগ্রিকভাবে বিভোর হয়ে যান। তারা ফানাফিল্লাহ্ পর্যায়ে উপনীত হয়ে যান। হযরত গওসুল আজম রহমাতুল্লাহি আলায়হি মুহীউদ্দীন খিতাব দ্বারা রূহানী জগৎ থেকে ভূষিত হয়েছিলেন। এই মুহীউদ্দীন শব্দের অর্থ দীনের পুনর্জীবনদানকারী। কাদিরীয়া তরীকায় জলী অর্থাৎ সশব্দ এবং খফী অর্থাৎ নিঃশব্দ। উভয় প্রকারের যিকর-আযকার করবার নির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতি রয়েছে। এই নিয়ম পদ্ধতিগুলো বইপত্র পড়ে অনুধাবন করা গেলেও চর্চা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই পীরের তালিম, তালকীন, ফয়েস ও তাওয়াজ্জুহর প্রয়োজন হয়। এই জন্য খাঁটি পীরের কাছে মুরিদ হওয়া অবশ্য কর্তব্য। এই তরিকায় আল্লাহ্ শব্দ দ্বারা কলবে জরব বা আঘাত করবার একটা বিশেষ নিয়ম আছে, যা পীরের কাছ থেকে যথাযথ ও নিয়মিত তালিম গ্রহণ করা ব্যতিরেকে সম্ভবপর হয় না। এছাড়া এই জরবের সময় পীরের তাওয়াজ্জুহ ও ফয়েস প্রকৃত আলোকধারা প্রবাহিত করে। বাংলাদেশে কাদেরীয়া তরিকার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে। যতদূর জানা যায় হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি, রাজশাহীর শাহ্ মখদুম রহমাতুল্লাহি আলায়হি, পশ্চিম বাংলার হযরত মনসুর রাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এই অঞ্চলে এই তরিকার ব্যাপক প্রসার ঘটান। গওসুল আজম আমাদের দেশে বড়পীর সাহেব হিসেবে সমধিক পরিচিত। ফাতিহায়ে ইয়ায্দহম প্রতিবছর আসে গওসুল আজমের স্মৃতিকে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করবার জন্য এবং তাঁর শিক্ষা ও আদর্শের আলোয় আলোকিত করবার জন্য। তিনি শুয়ে আছেন বাগদাদ শরীফে। বাগদাদ শরীফ এ বছর (২০০৩ খ্রীস্টাব্দে) বিদেশী হানাদার বাহিনীর দখলে থাকলেও সূফী জগতের বিলায়েতের রাজধানী। বাগদাদ শরীফ গওসুল আজমের কারণে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×