ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্জয় সরকার

উদীচী ট্র্যাজিডি

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

  উদীচী ট্র্যাজিডি

৮ ডিসেম্বর ২০০৫, সকাল সাড়ে ৮টা। নেত্রকোনা শহরের অজহর রোডে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয় সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায় লাল স্কচটেপে মোড়ানো একটি কৌটা দেখে জড়ো হলেন কিছু পথচারী। কৌটার ওপর ভাঁজ করা একটি চিঠি। তা দেখেই সন্দেহ বাড়ল প্রত্যেকের। কারণ দেশজুড়ে তখন ‘বোমা আতঙ্ক’। প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে বোমার সন্ধান মিলছিল। বোমাবাজির সিরিজ উৎসব শুরু করে দিয়েছিল উগ্র, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী জঙ্গীরা। খবর পেয়ে ছুটে এলেন দমকল কর্মীরা। তারা এসে কৌটার ওপর পানি স্প্রে করলেন। এরপর একটি বাঁশ দিয়ে সামান্য খোঁচা দিতেই সেটি বিস্ফোরিত হলো। তবে পানি স্প্রে করায় বিস্ফোরণ ততটা জোড়ালো হয়নি। সামান্য আহত হন পুলিশের এক সদস্যসহ কয়েক পথচারী। মুহূর্তের মধ্যে বোমার খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা শহরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, পথচারী ও উদীচী এবং শতদল গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকল উদীচীর সামনে। পরদিন ৯ ডিসেম্বর ‘নেত্রকোনা মুক্ত দিবস’ উপলক্ষে উদীচীতে একটি অনুষ্ঠানের মহড়াও চলছিল। এদিকে বোমা বিস্ফোরণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছুটে এলেন পুলিশ সুপারসহ স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে চলে গেলেন। আর এর মিনিট কয়েক পরই ঘটল সেই মর্মন্তুদ ঘটনা। মানুষের জটলার মধ্যে বাইসাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ল এক আত্মঘাতী কিশোর। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরণ ঘটাল শক্তিশালী আত্মঘাতী বোমার। শব্দে প্রকম্পিত হলো গোটা শহর। মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হলো উদীচী, শতদল ও আশপাশের এলাকা। স্পিøন্টারের আঘাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল অগণিত মানুষ। রক্তে ভেসে গেল অজহর রোড। শুরু হলো ছোটাছুটি। হতাহতদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হলো জেলা সদর হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও ‘বোমা আতঙ্ক’। গুজব ছড়িয়ে পড়ল- হাসপাতালের বারান্দায় রাখা আহতদের মধ্যে এক যুবক আত্মঘাতী জঙ্গী। তার শরীরে বোমা আছে। ফের বিস্ফোরণের ভয়ে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, চিকিৎসক-নার্সরা পর্যন্ত ভিতরে ঢুকল না। অচল হয়ে পড়ল জরুরী চিকিৎসা কার্যক্রম। বারান্দায় তখন আহতরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রূদ্ধশ্বাস সময় কাটছে হতাহতদের স্বজন, সাংবাদিক, পুলিশ ও উদ্বিগ্ন মানুষজনের। ঘণ্টা দেড়েক পর একজন বোমা বিশেষজ্ঞ এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বললেন, কারও শরীরে বোমা নেই। অচলাবস্থার কিছুটা অবসান ঘটল। দুপুর থেকে শুরু হলো ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহের ষড়যন্ত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক সদস্যকে বলতে শোনা গেল- ‘বোমা হামলায় আহত হিন্দু যাদব দাস একজন আত্মঘাতী জঙ্গী’। ঘটনার আকস্মিকতায় ঢাকা থেকে ছুটে গেলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও গণমাধ্যম কর্মীরা। নিহত যাদবের হিন্দুত্ব প্রমাণের জন্য তার (যাদবের) নিম্নাঙ্গের কাপড় পর্যন্ত খুলে দেখানো হলো প্রতিমন্ত্রীকে। মিডিয়াকর্মীরা ক্যামেরা তাক করে ‘নিজ জেলায়’ বোমা হামলার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন প্রতিমন্ত্রীর কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন- ‘ইটস্ এ্যা নিউ ডাইমেনশন ইন জঙ্গীবাদ’। আর এভাবেই মোটর গ্যারেজের কর্মচারী ‘হিন্দু’ যাদব হয়ে গেল তথাকথিত ইসলামী শাসন কায়েমের ‘আত্মঘাতী জঙ্গী’! বিশ্বের ইতিহাসে আবিষ্কার হলো নতুন এক জঙ্গীতত্ত্ব। গ্রেফতার করা হলো যাদবের বৃদ্ধ-বাবা মাকে। থানায় আটক রাখা হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘হিন্দু জঙ্গী’ আবিষ্কার নাটক ভেস্তে গেল সাধারণ জনতার প্রতিবাদের মুখে। রাস্তায় নামল মানুষ। সোচ্চার হলেন প্রগতিশীল মিডিয়া কর্মীরা। বিক্ষোভ মিছিল-মিটিংয়ে উত্তাল হয়ে উঠল নেত্রকোনা। এমন নেত্রকোনা এর আগে কখনও দেখেনি কেউ। দ্রোহের মুখে এক পর্যায়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন প্রতিমন্ত্রী। জেএমবি নামধারী জঙ্গীগোষ্ঠীর বোমা হামলায় সেদিন আটজন প্রাণ হারান। এরা হলেন- উদীচীর দুই সংগঠক খাজা হয়দার হোসেন ও সুদীপ্তা পাল শেলী, যাদব দাস, রাণী আক্তার, জয়নাল আবেদীন, আফতাব উদ্দিন, রইছ উদ্দিন এবং আত্মঘাতী কিশোর কাফি (জামালপুর)। আহত হন ৯ পুলিশ সদস্যসহ ৫২ জন। দেশবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। জেলহত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের গলায় ফাঁসির দড়ি পড়েছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের এসব অগ্রগতি জাতিকে ক্রমশ কলঙ্কমুক্ত করছে। কাজেই আমরা এখন আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস করি- উগ্র মৌলবাদী, ধর্মান্ধ বা জঙ্গীগোষ্ঠীও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আর পার পাবে না। আশার কথা, এরই মধ্যে অসংখ্য জঙ্গী আইনের আওতায় এসেছে। এদের অশুভ তৎপরতা কমতে শুরু করেছে। জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত দেশ গঠনের এ অভিযানকেও চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি আরও গতি সঞ্চার করতে হবে সাংস্কৃতিক কর্মকািন্ডে। ধর্মান্ধতা রুখে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকতে দিতে হবে প্রজন্মকে। আমরা আর কোন হায়দার-শেলীকে হারাতে চাই না। দেখতে চাই না ‘নিউ ডাইমেনশান’ খ্যাত আর কোন নাটক। সুন্দর মানুষগুলো জেগে উঠলে অসুন্দর কখনও জয়ী হয় না। দেশ, সত্য ও সুন্দরের জন্য যারা জীবন দিয়ে গেছেন- তাদের ত্যাগকে পাথেয় করেই সামনের দিকে এগোতে হবে আমাদের। লেখক : সাংবাদিক, উদীচী কর্মী
×