ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জলি রহমান

নারী শ্রমশক্তির মূল্যায়নে বাড়বে প্রবৃদ্ধি

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

নারী শ্রমশক্তির মূল্যায়নে বাড়বে প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সর্বস্তরেই ঈর্ষণীয় সাফল্য। তথ্য মতে ২০২০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধিকে টেকসই ও মজবুত করতে কাজে লাগাতে হবে নারী শ্রমশক্তিকে। যেহেতু আমাদের শ্রমশক্তির অর্ধেক নারী। তারা ঘরে-বাইরে সমান তালে কাজ করছে। নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। এসব কাজের নেই কোন আর্থিক মূল্যায়ন। আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় শুধু এতটুকুই যারা ঘরের বাইরে কাজ করছে। কিন্তু দাদি- নানি থেকে শুরু করে বর্তমান মায়েরা ভোর থেকে শুরু করে রান্না-বান্না করা, সন্তানের লালন-পালন ও পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের যতœ নেয়া, এছাড়াও নিজ সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়া করা । এসব কাজগুলোকে আমরা সেবামূলক কাজ বলে থাকি। এ ধরনের কাজের নেই কোন মূল্যায়ন। ২-৩ ডিসেম্বর বেসরকারী এনজিও এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও পিআইবির যৌথ উদ্যোগে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেক্ষাপট ছিল গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ। ওই কর্মশালায় পিআইবি পরিচালক জনাব জাফর ওয়াজেদ বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের সেবামূলক কাজকে কাজই মনে করা হয় না। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে সচেতনতার অনেক অভাব রয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন সহজে করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে’। ওই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক জনাব তাসমিমা হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন নারী তার সংসারে যা করছে তার মূল্যায়ন হচ্ছে না। শহরের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনেক নারী অসামান্য অবদান রাখছে। তার উপার্জনে চলছে পুরো পরিবার। এদের নেই কোন সঠিক পরিসংখ্যান। তাদের উৎপাদান সঠিকভাবে বাজারজাত করলে অনেক দূরে এগিয়ে যাবে এসব নারীরা’। নারীদের কাজের মূল্যায়নে এ্যাকশন এইডের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের তৈরি পণ্যসামগ্রী সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। যাতে কোন মধ্যস্বত্বভোগীদের কবলে পড়তে না হয়। পাশাপাশি নারীদের সচেতন করতে কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তুলেছে তাদের কর্মশালা। প্রসঙ্গত এ্যাকশন এইডের মতে, সেবামূলক ও জীবনধারণের জন্য আবশ্যক যে কাজগুলো নারীরা ঘরে নিয়মিত করে কিন্তু মূল্যায়ন করা হয় না, তাই গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ। এ কাজের মধ্যে আছে রান্না করা, সন্তান লালন-পালন করা, থালাবাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া ও পরিবারের সদস্য-বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা করা। এ সকল কাজের অর্থনৈতিক বা সামাজিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। ২০১৭ সালে একশনএইড বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, নারীরা গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের মধ্যেই সর্বাধিক নিযুক্ত থাকেন এবং এই কাজে পুরুষের অংশগ্রহণের সঙ্গে নারীর অংশগ্রহণের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মোট কর্মঘণ্টার (১২) মধ্যে একজন নারী গড়ে ৭.৫০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেণ এ কাজে। অপরদিকে একজন পুরুষ সেবামূলক কাজে ব্যয় করেণ মাত্র ৩.৮৫ ঘণ্টা। গৃহস্থালির কাজে বেশি সময় দেয়ার কারণে অনেক নারী চাকরি করতে পারেন না। আবার শিশুসন্তান লালন-পালনের জন্য অনেকে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এসব ক্ষেত্রে পুরুষদের তেমন কোন সমস্যা হয় না। এছাড়া রান্নাবান্নাসহ বাসার আনুষঙ্গিক কাজ করতে হয় বলে নারীদের পক্ষে নিয়মিতভাবে কোন কাজ বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব হয় না। কয়েক বছর আগে নারীর মজুরিবিহীন কাজের একটি হিসাব করেছে সিপিডি। সেখানে কাজের ছায়া মূল্য ব্যবহার করে সিপিডি প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে দেখিয়েছে যে জাতীয় আয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না এমন কাজ, নারীরা যা করছেন সব মিলিয়ে এর আনুমানিক বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অর্থবছর) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমপরিমাণ। এ ধরনের হিসাব যোগ হলে জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে। যেসব নারীদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছর, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ শ্রমবাজারে আছে। আর পুরুষদের মধ্যে ৫৪ শতাংশই শ্রমবাজারে আছে। এই বয়সের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় বলে তাঁরা শ্রমবাজারে যেতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বিবিএসের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিভাগীয় পর্যায়ে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রংপুরে এ হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায় শহরের চেয়ে গ্রামে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা বেশি। নিজ পরিবারেও ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর শ্রম পুরুষের তুলনায় বেশি। গ্রামে শতকরা ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমজীবী হিসেবে রয়েছে। শহরে কমে হয়েছে ৩১ শতাংশ। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, শহর ও গ্রাম মিলিয়ে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ, ২০০৫ সালে যা ছিল ২৯ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) মতে, ১৯৯৫-৯৬ সালে শ্রমে নারীর অবস্থান ছিল শহরে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, গ্রামে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৩ সাল পর্যন্ত শহরে এ হার বেশি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ‘জিডিপিতে নারীর অবদান হিসাব করা হলে তা তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। যদিও দেশের পরিসংখ্যানে এখনও অস্পষ্টতা রয়েছে। জনসংখ্যার অবস্থা বদলে যাচ্ছে। আগামী দুই দশকে জনসংখ্যার বোনাসকাল শেষ হবে। তখন বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়লে সেবামূলক কাজের পরিধি বাড়বে। এই সেবার জন্য বাড়িত অর্থ ব্যয় করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, পোশাক শিল্পে অনেক বেশি নারী ঢুকেছে বলেই অর্থনীতি এত এগিয়েছে। তবে নারীদের প্রতিবন্ধকতা অনেক। এ ক্ষেত্রে সন্তান পালনে কর্মস্থলে, বস্তিতে সরকারী-বেসরকারীভাবে ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে তুলতে হবে।’ তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা রয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী। সুতরাং বাংলাদেশ নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে, তবে আরও বেশি এ নিয়ে গবেষণা হলে, নারীদের সকল কাজের মূল্যায়ন করলে দেশের অর্থনীতি হবে আরও সমৃদ্ধ।
×