ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

ফরিদা জামানের শিল্পকর্মে আটপৌরে জীবনের বয়ান

প্রকাশিত: ১১:১৮, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

ফরিদা জামানের শিল্পকর্মে আটপৌরে জীবনের বয়ান

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রদর্শনালয়ে প্রবেশেই নজর কাড়ে স্থাপনাশিল্পটি। জ্যামিতিক ফর্মে কোনাকোনি স্থাপিত হয়েছে বাঁশের মাচা। ত্রিকোণবিশিষ্ট মাচার ওপর থেকে নিচ অবধি ঝুলছে মাছধরা জাল। জালের পাশে শোভা পাচ্ছে মাছ ধরা ও রাখার দুই অনুষঙ্গ পোলো এবং খালোই। মেঝেতে দৃশ্যমান নদীর জোয়ারে উঠে আসা কাদার স্তূপ। বিছিয়ে রাখা স্বচ্ছ পলিথিনের ব্যবহারে সৃষ্টি হয়েছে চকচকে ¯্রােতস্বিনী জলধারা। সে জলে ভাসছে বৈঠাসহ কালো রঙের ডিঙি নৌকাখানি। প্রথমবারের মতো নান্দনিক স্থাপনাশিল্পটি নির্মাণ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ফরিদা জামান। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনালয়ে দর্শকরা গভীর নিয়ে দেখছিলেন শিল্পকর্মটি। সেটি দেখে অনেকেই যেন খুঁজে ফিরছিলেন শিকড়ের হাতছানিময় গ্রামীণ জীবনকে। বারবার তাদের চোখে পড়েছে আটপৌরে জীবনচিত্র। গ্যালারিজুড়ে সেই জীবন আখ্যানকে মেলে ধরেছেন শিল্পী। একটি স্থাপনাশিল্পের সঙ্গে চিত্রকর্মে সজ্জিত প্রদর্শনীটির শিরোনাম ‘ফর দ্য লাভ অব কান্ট্রি’। আবহমান বাংলার নিসর্গ ও জীবনকে আশ্রিত করে চিত্রিত হয়েছে চিত্রকর্মগুলো। উদ্ভাসিত হয়েছে ফুল, পাখি, লতাপাতা, বৃক্ষ থেকে তৃণলতা। আছে মাছের কাটা খাওয়ার অপেক্ষায় থাকা বিড়ালের গল্প। তবে স্বাভাবিক রূপকের বাইরে কল্পনার ডানায় ভর করে আঁকা হয়েছে বিড়ালের সিরিজে ছবিগুলো। সে কারণেই বিড়ালের গলাটি হয়েছে জিরাফের মতো লম্বা। চেহারায় ফুটে উঠেছে মনুষ্য অবয়ব। এমন করে প্রতিটি চিত্রকর্ম সৃজনে রিয়েলিটি বা বাস্তবতাকে ডিঙিয়ে আধা বিমূর্ত রীতিতে ধাবিত হয়েছেন শিল্পী। প্রকৃতি ও প্রাণীর সমান্তরালে নাগরিক জীবনের মাঝে খুঁজেছেন আটপৌরে জীবনের বয়ান। সেই সূত্রে এঁকেছেন সুফিয়া সিরিজের কয়েকটি ছবি। এই সিরিজের চিত্রকর্মগুলোয় উঠে এসেছে সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। নিরন্তর লড়াই করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার কথা বলে মেদহীন শরীরের হাড্ডিসার দেহখানি। লাল-নীল জমিনের চিত্রপটে উদ্ভাসিত গ্রাম থেকে শহরে আসা সুফিয়ার চারপাশ ঘিরে রয়েছে পাখপাখালি আর শাপলা-শালুক। আপন শিল্পকর্মের ভেতর ফেলে আসা আটপৌরে জীবনের গল্প খুঁজেছেন ফরিদা জামান। সেই সুবাদে প্রদর্শনী প্রসঙ্গে শিল্পীর ভাষ্যটি এরকম, আমি খুব সাধারণ জীবন যাপনে বিশ্বাসী। এটাই আমার দর্শন। ছোটবেলা থেকেই শখ ছিল শিল্পী হবার। তাই গাছপালা, ফুল-পাখি টানতো ভীষণ। বাবার চাকরির জন্য বহু জায়গায় গেলেও চন্দ্রঘোনার সেই পাহাড়ের চূড়ার বাড়িটা, পাহাড়ী ঢালু পথ, ঘন সবুজ সারল্য থেকে স্কুল প্রাঙ্গণÑগভীর প্রভাব ফেলেছিল হৃদয়ে। কল্পনার বাস্তব আবার বাস্তবের কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। ইচ্ছা জাগতো ভালবাসার সেই অনুভব প্রকাশের। ডাকাতিয়া নদী, নৌকার পাটাতন, অথৈই জলের মাঝে সবুজে আবৃত চাঁদপুরের পাখিয়াখালি গ্রামের বাড়িতে আমার বেড়ে ওঠা। কয়েকটি স্কুল অদল-বদল শেষে ভর্তি হই আর্ট কলেজে। এর মাঝে জীবনে আসে উত্তাল একাত্তর। সেসময় অনেক ভাইবোনসহ বন্দী জীবন কাটে একটি ঘরে। সঙ্গী হয় একটি জানালা, দূরের একটি জলাশয়, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ও জেলেদের জীবনের নানা অনুষঙ্গ। এগুলো ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল আমাকে। কঠিন এক বেদনাবোধে নিজেকে জড়িয়ে রাখি জেলেদের জালে। সেই ভাবনা থেকে শুরু আমার মাছ ধরার জাল সিরিজ। অন্যদিকে ঢাকার নাগরিক জীবনে দেখেছি জীবিকার তাগিদে পথে পথে ফুল বা ছাই বিক্রি করছে গ্রাম্য কিশোরী।
×