ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব শুরু

৪৫ দেশের শতাধিক চলচ্চিত্র, চমৎকার আদান প্রদান

প্রকাশিত: ১১:১৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

৪৫ দেশের শতাধিক চলচ্চিত্র, চমৎকার আদান প্রদান

মোরসালিন মিজান ॥ অনেক পুরনো একটি জার্নি। ৩৩ বছর আগে এ জার্নি শুরু করেছিল বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরাম। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে দুই বছর পর পর আয়োজন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক উৎসবের। শনিবার থেকে শুরু হলো আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবের ১৫তম আসর। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে সন্ধ্যায় এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তার আগে উৎসবের প্রধান ভেন্যু গণগ্রন্থাগার চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের প্রতিকৃতি দিয়ে মোটামুটি চারপাশটা সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। মাঝখানের খোলা জায়গায় আড্ডায় জমিয়েছেন দেশী বিদেশী অতিথিরা। কেউ চলচ্চিত্র নির্মাতা। কেউ জুরিবোর্ডের সদস্য। চলচ্চিত্রপ্রেমীরাও উপস্থিত হয়েছিলেন। যে যার মতো করে আলাপ জমিয়েছিলেন তারা। গল্প আড্ডায় অংশ নিতে দেখা যায় উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মোরশেদুল ইসলাম, ভারতীয় পরিচালক কুমার সাহানী, হংকংয়ের চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক স্যাম হোসহ অনেককে। একে একে আসতে থাকেন সাধারণ দর্শকও। এভাবে উৎসবের আনন্দটা মোটামুটি ছড়িয়ে পড়ছিল। সন্ধ্যার কিছু আগে এসে উপস্থিত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। প্রধান অতিথি হিসেবে তিনিই উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ সময় জাতীয় পাতাকা উত্তোলন করা হয়। গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। একই সময় উৎসব পতাকা উত্তোলন ও বেলুন ওড়ানো হয়। বাইরের আনুষ্ঠানিকতা বলতে এটুকুই। পরে মিলনায়তনের ভেতরে শুরু হয় মূল আনুষ্ঠানিকতা। এখানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটকের সুযোগ্য শিষ্য প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা কুমার সাহানী ও একই দেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্য রচয়িতা কমল স্বরূপ। উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন ইউসুফের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসব পরিচালক এন. রাশেদ চৌধুরী। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সভাপতি জাহিদুর রহিম অঞ্জন। অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশী নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। তার হাতে হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। এর আগে উৎসবস্থলে কথা হয় ভারতের অত্যন্ত খ্যাতিমান নির্মাতা কুমার সাহানীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আসাটা আমার জন্য সব সময়ই আনন্দের। এ উৎসবের একেবারে গোড়ার দিকে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেই স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। এখানে অনেক ছাত্র আছে আমার। তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে উৎসব। আমি একটা মাস্টার ক্লাস নেব। সব মিলিয়ে খুব ভাল অভিজ্ঞতা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। হংকংয়ের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব স্যাম হো আরও বেশি আড্ডাপ্রিয় বলে মনে হলো। তিনি চলচ্চিত্র ছাড়াও ইতিহাস নিয়ে বিশেষ আগ্রহী। বলছিলেন, ভারতীয় বা বাংলাদেশীদের মতো আমাদেরও কলোনিয়াল অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে সিনেমায় দেখতে তার ভাল লাগে বলে জানান তিনি। তার আলোচনায় ওঠে আসে সাহিত্যও। বলেন, ভারতের অনেক সাহিত্যিক ইংরেজীতে বেশ ভাল লিখে চলেছেন। তার কথা থেকে এ বার্তাটিও পাওয়া যায় যে, এ জায়গায় বাংলাদেশ পিছিয়ে। তবে এ দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আশাবাদী বলে জানান তিনি। খোলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কথা হয় উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গেও। তিনি বলছিলেন, এ উৎসব এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। ওল্ডেস্ট। বিগত দিনে যারা আয়োজনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের হাতেই এখন বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র। নানাভাবে তারা চলচ্চিত্রে অবদান রেখে চলেছেন। ভবিষ্যতের নির্মাতাদের কাছেও এ উৎসব অনুপ্রেরণার হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সভাপতি জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সঙ্গেও কথা হয় কিছুক্ষণ। তিনি বলেন, যারা ইন্ডাস্ট্রির বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করেন, শৈল্পিক সিনেমা, সমাজ- দায়বদ্ধ সিনেমা তৈরি করতে চান তাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া এ উৎসব। পৃথিবীর সমকালীন শর্টফিল্মে কী হচ্ছে, ভাষাটা কী, আগামী দিনের নির্মাতারা এখানে এসে তা জানতে পারবেন। আর দর্শক পাবেন দারুণ সব চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ। এদিন প্রধান ভেন্যু শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে ৫টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। একই দিন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে ৩টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখানো হয়। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ভেন্যু জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তন। অন্য ভেন্যুগুলোর মধ্যে শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত আবৃত্তি ও নৃত্যকলা মিলনায়তন ও সেমিনার হল। আজ রবিবার থেকে সবকটি ভেন্যুতে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। আয়োজকরা জানান, সপ্তাহ্যবাপী উৎসবে ৪৫ দেশের শতাধিক স্বল্প ও মুক্ত দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র দেখনো হবে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইরানের আব্বাস কিয়ারোস্তামী, আমেরিকার মায়া ডেরেন, জোনাস মেকাস, ফ্রান্সের এগনেস ভার্দা, গ্রীসের থিও এঞ্জেলোপোলাস, ভারতের মৃণাল সেন এবং বাংলাদেশের সাইদুল আনাম টুটুল ও চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন স্মরণে দেখানো হবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আয়োজন থাকছে। আলমগীর কবির স্মারক বক্তৃতা, তিনটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও একটি মাস্টার ক্লাসের আয়োজন করা হবে উৎসবে। একটি কর্মশালায় স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সম্ভাবনা বিষয়ে আলোচনা হবে। প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন ভারতের এফটিআইআইয়ের শিক্ষক চলচ্চিত্র নির্মাতা অনির্বাণ দত্ত ও কানাডার তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক জেসি আল্ক। অন্যটিতে কথা হবে চিত্রনাট্য রচনার সাম্প্রতিক ট্রেন্ড নিয়ে। এ কর্মশালার প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন যুক্তরাজ্যের চলচ্চিত্র সমালোচক নামান রামাচন্দ্রন। ‘অরালিটি এ্যান্ড মুভমেন্ট’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক লেকচার প্রদান করবেন তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক ও ভারতীয় বিশিষ্ট অনুবাদক বিদ্বূষী ডঃ রিমলি ভট্টাচার্য্য। এবারের উৎসব স্বাধীন চলচ্চিত্র ধারার অন্যতম গুণী নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন ও চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মুহাম্মদ খসরুর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। আগামী ১৩ ডিসেম্বর পর্দা নামবে আন্তর্জাতিক এ উৎসবের।
×