ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টপ টেরর তানভির কানাডা থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ায়

প্রকাশিত: ১১:০০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

টপ টেরর তানভির কানাডা থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ায়

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানী ঢাকার পুরস্কার ঘোষিত টপ টেরর খন্দকার তানভিরুল ইসলাম জয়-ই কি কলকাতায় গিয়ে তারেক রানা ছদ্মনাম নিয়ে বসবাসের পর এখন কানাডায় অবস্থান করছে? ঢাকার তানভির ইসলামের ছবির সঙ্গে কলকাতায় অবস্থানের সময়ে এবং এখন কানাডায় অবস্থানকারী তারেক রানার ছবির সাদৃশ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। শুধু ছবির সাদৃশ্যই নয়, নামে মিল, পিতৃ পরিচয়, জন্মতারিখ, শরীরী চিহ্ন সবকিছুতেই আশ্চর্য রকমের মিল দেখা যায় বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড জয়ের সঙ্গে তারেকের। জয় নামের তারেক রানা একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশ-ভারত-কানাডার গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে টপ টেররদের নাম ঘোষণা করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার পর ঢাকা থেকে পালিয়ে যায় তানভিরুল ইসলাম জয়। পালিয়ে অবস্থান নেয় কলকাতায়। কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে কাটিয়ে জামিনে বের হয়। তারপর পালিয়ে চলে যায় কানাডায়। এখন নাকি কানাডা থেকে পালিয়ে অবস্থান করছে মালয়েশিয়ায়। নাম ও দেশ পরিবর্তন করে রীতিমতো তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত-কানাডার গোয়েন্দারা তো বটেই, খোদ ইন্টারপোলও নিশ্চিত, তাদের জারি করা ‘রেড কর্নার নোটিস’ যার বিরুদ্ধে, সেই খোন্দকার তানভির ইসলাম এবং কানাডার তারেক রানা আদতে একই ব্যক্তি কি ? কে এই খোন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়? আর কে-ই বা তারেক রানা? বাংলাদেশের টপ টেরর জয় রাজধানী ঢাকায় কয়েক ডজন খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ মামলায় অভিযুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অনুরোধে ইন্টারপোল ‘রেড কর্নার নোটিস’ জারি করে তার বিরুদ্ধে। সেই সময়েই তারা জয়ের মাথার দাম রেখেছিল ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের কুখ্যাত সেভেন স্টার গ্যাংয়ের পাণ্ডা সে। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা চাঁদা আদায় করে ‘সেভেন স্টার গ্যাং’। টাকা না দিলে খুনও করতে পিছপা হতো না জয়। গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ২০০৬-এর ১৪ মে বিদেশে কাজের জন্য বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া সংস্থা ‘তুর্কি এ্যাসোসিয়েট’-এর মালিককে ৮ লাখ মার্কিন ডলার চেয়ে ফোন করে জয়। টাকা না দেয়ায় ওই সংস্থার অফিসে ঢুকে ৬ জনকে গুলি করে খুন করে জয়ের দলবল। জয় তখন সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে টাকা চেয়েছিল। এ রকম একের পর এক খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিদেশে পলাতক থেকে এখনও ঢাকা শহরের বুকে জয়ের দলবল টাকা তোলে একইরকমভাবে। বাংলাদেশী টাকায় ৫ কোটি পর্যন্ত তোলা চায় জয়ের গ্যাং! এক সময়ে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবেও পরিচয় দিত সে! কিন্তু, জয়কে সেই সময় কেউ ধরতে পারেনি। গোয়েন্দা সংস্থার নথি থেকে জানা যায়, সেটা ২০০৭ সালের কথা। কলকাতার বাগুইআটির চিনার পার্কের একটি বাড়ি থেকে জয়কে গ্রেফতার করে কলকাতা রাজ্যের সিআইডি। দেখা যায়, ভোল বদলে তারেক রানা নামে সে গাঢাকা দিয়েছিল বাগুইআটির ওই ভাড়া বাড়ি থেকে। ভুয়ো নথির মাধ্যমে তারেক রানা নামে সে ততদিনে ভারতীয় পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স সবই যোগাড় করে ফেলেছে। এ দেশে তার পরিচয় তখন ‘জি ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক সংস্থার মালিক! সিআইডি তার বিরুদ্ধে পাঁচটি আলাদা আলাদা মামলা রুজু করে। তখন গ্রেফতার করা হয় জয়কে। এই মামলাগুলো যখন চলছে তখনই জয়কে ফেরত পেতে ভারতকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। ওই প্রত্যর্পণ নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই জামিন পেয়ে যায় জয়। তার পর প্রায় কর্পূরের মতো উবে যায় সে কলকাতার বুক থেকে। কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার পর তানভিরের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পায় সিআইডি। এর পর জয়ের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কানাডার অভিবাসন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে পর্যটক ভিসা নিয়ে সে দেশে তারেক রানা নামে এক ব্যক্তি যান। সেই তারেক রানাকেই ২০১৪ সালে কানাডার অভিবাসন দফতর ১০ বছরের ভিসা দেয়। তখন থেকেই তিনি সেখানে আছেন। কানাডার টরন্টোর শহরতলি আয়াক্সে ওই বাংলাদেশের সেই জয় ভারতীয়ের নাম একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারেকের দাবি, তার জন্ম থেকে বড় হওয়া সবটাই কলকাতায়। আয়াক্সের অভিজাত এলাকায় তার ‘এসজে ৭১’ সংস্থার বিশাল অফিস রয়েছে। নিয়মিত তাকে সেখানকার ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা যায়। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের অর্থসাহায্য করেন তিনি। এমনকি সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলেও দেন মোটা চাঁদা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে তারেককে একজন উদ্যোগপতি হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি সে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, এনেছেন বিনিয়োগও। বাংলাদেশের টপ টেরর জয় কলকাতার গ্রেফতার হওয়া উদ্যোগপতি হিসেবে আয়াক্সে থাকা তারেক রানার সঙ্গে একের পর এক সাদৃশ্যের হদিস পান কানাডার পুলিশ কর্তারাও। ২০১১ সালে প্রথমবার কানাডা যান তারেক রানা। ২০১৪ তে তৈরি করেন সম্পত্তি কেনাবেচার ‘এসজে ৭১’ সংস্থা। সম্প্রতি ‘এসজে ৭১’-এর ডিরেক্টর তারেক রানার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভীরের সঙ্গে সব রকম মিল খুঁজে পেয়েছে কানাডা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। কী রকম? গোয়েন্দারা নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন। এতে দেখা যায়, ২০০৫ সালে খোন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়ের যে ছবি ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিসে রয়েছে, তার সঙ্গে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া জয়ের ছবি এবং তারেক রানার সাম্প্রতিক ছবিতে সাদৃশ্য রয়েছে। খোন্দকার তানভিরের বাবার নাম এবং তারেক রানার বাবার নাম এক, খোন্দকার নজরুল ইসলাম। খোন্দকার তানভির এবং তারেক রানার জন্মসাল এক, দু’জনেরই ১৯৬৭ সালে জন্ম। অতীতে দু’জনেরই দু’পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার চিহ্নও দু’জনের শরীরে রয়েছে। শুধু কানাডার অভিবাসন দফতর নয়, সিআইডির আধিকারিকরা, যারা জয়কে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার করেছিলেন, তারাও কানাডার তারেক রানার ছবি দেখে এক মুহূর্তে চিনতে পারছেন। তারা নিশ্চিত, বাংলাদেশের কুখ্যাত ডন খোন্দকার তানভির ইসলামই আসলে এই তারেক রানা। সিআইডি যখন জয়কে চিনার পার্ক থেকে গ্রেফতার করে তখন সে বাড়িতে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিল। গ্রেফতারের কয়েক দিন আগে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারী হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার হয়। সে কারণে তাই জয়ের গ্রেফতারির পর এমআর বাঙুল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করেছিল সিআইডি। কানাডার অভিবাসন দফতরের কাছে ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দেয়া তারেক রানার ফাইলেও রয়েছে পায়ের অস্ত্রোপচারের তথ্য। প্রশ্ন উঠছে, জয়কে বাংলাদেশে টপ টেরর হিসেবে ঘোষণার পর তাকে ধরিয়ে দেয়ার পর পুরস্কার ঘোষণার পর পালাল কিভাবে ? জয়ের বিরুদ্ধে ব্যারাকপুর, কসবা, দমদম, তিলজলা এবং কাঁকসা থানায় পাঁচটি মামলা থাকার পরেও সে কীভাবে জামিন পেল? জামিন পাওয়ার পর কীভাবেই বা কলকাতা ছেড়ে পালাল? কানাডাতে ঠিক যেভাবে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা করে উদ্যোগপতি হয়ে উঠেছিল জয় ওরফে তারেক রানা, ঠিক সেই ভাবেই দেশ ছেড়েছিল বাংলাদেশের টপ টেরর। তারেক রানা কী বলছেন এ বিষয়ে? কানাডার এই উদ্যোগপতি প্রথমে এ বিষয়ে কোন কথা বলতেই রাজি হননি। শেষবার যখন কথা হয়, তখনও তিনি কানাডাতে। কানাডার পুলিশ তাকে, তবে কানাডার তারেক রানার দাবি, তার সঙ্গে নাম, পরিচয়সহ সবকিছুর যতই মিল থাকুক না কেন তিনি তানভির ইসলাম জয় নামে কাউকে চেনেন না। তারেককে প্রশ্ন করা হয়, তাকে কি কখনও কলকাতায় গ্রেফতার করা হয়েছিল? তারেক দাবি করেন, তার জীবনে কখনও কোন অপরাধের সঙ্গে যোগ ছিল না। ফলে গ্রেফতারের প্রশ্নই নেই বলে জানিয়েছিলেন কানাডার ওই উদ্যোগপতি। তা হলে কলকাতা হাইকোর্টে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে খোন্দকার তানভির ইসলাম জয় ওরফে তারেক রানা (সিআরআর ২৮৮৭/২০০৭) হিসেবে তিনি কেন তার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চলা মামলা খারিজ করার আবেদন জানিয়েছিলেন? সেখানে তো তারেক রানার সঙ্গে মোস্ট ওয়ান্টেড খোন্দকার তানভির ইসলাম জয় নামটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন কেন? তাকে এটাও সেই সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ওই মামলার নথি থেকে হদিস মিলেছে, তারেকের যে ভারতীয় পাসপোর্ট (এফ ১১১৫১৩৪) তা আসলে ভুয়ো নথি দিয়ে বানিয়েছিল জয়। কলকাতার সিআইডি আদালতে তেমনটাই জানিয়েছিল। এবারও নিরুত্তর ছিলেন তারেক। আর সিআইডি বলছে, ওই ভুয়ো পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তারেক রানা কানাডা যাওয়ার জন্য ১০ বছরের ভিসা পেয়েছিলেন! কানাডার অভিবাসন দফতর একাধিকবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর পর হঠাৎ করেই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান। কানাডায় তার পরিচিতদের তারেক জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ২৮ নবেম্বরের মধ্যে তিনি ফিরবেন আয়াক্সে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি কানাডায় ফেরেননি। তিনি কোথায় আছেন জানতে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ওই মোবাইল নম্বরে রয়েছেন। কানাডা পুলিশ জানাচ্ছে, তার আয়াক্সের অফিস তালাবদ্ধ। পাওনাদাররা টাকা না পেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। তবে কি ভোজবাজির মতোই মোস্ট ওয়ান্টেড জয় হয়ে গেলেন কানাডার ‘প্রতিশ্রুতিমান উদ্যোগপতি’ তারেক রানা! পর পর উঠে আসা তথ্য-প্রমাণ থেকে স্পষ্ট, কানাডার হোমরাচোমরাদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করা তারেকই জয়ের আর এক নতুন অবতার। যেমন কলকাতায় তার অবতার ছিল পোশাক সংস্থার মালিক। কানাডায় তার অবতার এসজে ৭১-এর ডিরেক্টর। সম্প্রতি কানাডার একটি শহরে পুর প্রশাসনের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন তারেক। তবে কানাডার তারেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি ঢাকা বা কলকাতার জয়ের সঙ্গে মিলগুলোকে মুছে ফেলা। টপ টেরর থেকে উদ্যোগপতি হয়ে উঠলেও গোয়েন্দা চোখের আড়ালে যাওয়া যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনই ফেরার হয়ে নিজেকে লুকনোও ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে তার। তার মোবাইল এখন নিষ্ক্রিয়। ই-মেলও অকার্যকরী হয়ে রয়েছে। আর সেখানেই প্রশ্নটা উঠছে, তারেক যদি মোস্ট ওয়ান্টেড জয়-ই যদি না হন, তবে নিজের এত বড় ব্যবসা ফেলে কেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন!
×