ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

‘চলুন সোনার বাংলা গড়ি’

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

‘চলুন সোনার বাংলা গড়ি’

১৯৭১ সালের ০৮ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বুধবার। এই দিন পাকবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্মিলিত বাহিনী চারদিক থেকে হানাদারদের ঘিরে ফেলেছে। রণাঙ্গনে ব্যাপক সুফল পেতে থাকে মিত্র বাহিনী। ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথ তাদের আর নেই। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেওয়ারও কোন উপায় নেই। এই সুযোগে মিত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বিভিন্ন ভাষায় হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করে বাণী ও লিফলেট আকাশে ছড়িয়ে দেন। দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এই আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে পাকবাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মানেকশ-এর এই আহ্বান আকাশবাণী থেকে নানা ভাষায় বার বার প্রচার করা হয়। কিন্তু পাক সামরিক শাসকরা কিছুতেই আত্মসমর্পণের দিকে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সেনাসদস্যদের নির্দেশ দেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে হানাদার বাহিনীকে একের পর এক পরাজিত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী। কুমিল্লায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিসেনারা আর্টিলারি আক্রমণ চালিয়ে শেষ রাতের দিকে তাদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়। রাতব্যাপী যুদ্ধে ২৬ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রাতে মিত্রবাহিনীর ১১ গুর্খা রেজিমেন্টের আর জে মজুমদারের নেতৃত্বে কুমিল্লা বিমানবন্দরের তিনদিকে আক্রমণ চালানো হয়। সীমান্তবর্তী বিবির বাজার দিয়ে লেঃ দিদারুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল এবং অপর দুটি দল গোমতী নদী অতিক্রম করে ভাটপাড়া হয়ে চৌদ্দগ্রামের বাঘের চর দিয়ে এসে বিমান বন্দরের পাক সেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। রাতের মধ্যে বিমান বন্দরের ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পাক সেনাদের প্রধান ঘাঁটির পতন হয়। হানাদার বাহিনীর কতিপয় সেনা বিমান বন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে বরুড়ার দিকে এবং সেনানিবাসে ফিরে যায়। বিমান বন্দরের ঘাঁটিতে ধরা পড়া কতিপয় পাক সেনা আত্মসমর্পণ করে। কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদারমুক্ত হয়। রাস্তায় নেমে আসে উল্লসিত জনতা। কুমিল্লার আপামর জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে মুক্তির উল্লাসে বরণ করে নেয়। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রেহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী, দলীয় পতাকা এবং কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১৭০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এরপর ৬৫ জন পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ও রাজাকার পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আত্মসমর্পণ করে। এদিনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরকে শত্রুমুক্ত করে থানা চত্বরে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েক’শ নারী-পুরুষ শহীদ হন। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়। হাজীগঞ্জে পাকবাহিনী প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। একটানা যুদ্ধ চলে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা। ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ে শত্রুপক্ষ। অবশেষে ওই পক্ষের ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের মেজর কমান্ডিং আফিসার জেনারেল রহিম খান হাজীগঞ্জ হামিদ জুটমিলসহ তাদের সবগুলো ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে শুরু করে। ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে চাঁদপুর শহরে এসে তারা যখন নদীপথে গানবোট, লঞ্চ, স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য জায়গায় রওনা দেয় তখনই চাঁদপুরের বিভিন্ন শ্যামল প্রান্তর মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নৌযানের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। মেজর জেনারেল রহিম খানও আহত হন। তবে তাঁর ভাগ্য ভাল ঢাকার দিক থেকে উড়ে আসা একটি হেলিকপ্টার তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। সকাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা মহকুমা শহরটিতে প্রবেশ করে। বিএলএফ বাহিনীর চাঁদপুর মহকুমা কমান্ডার রবিউল ইসলাম কয়েক হাজার জনতার সমাগমে চাঁদপুর থানার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা। মুক্তিফৌজের একটি দল এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে ঢাকার দিকে। অপর একটি বাহিনী আশুগঞ্জ সেতুর দিকে এগুচ্ছিল। ৫৭তম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছায়। পাকিস্তানী বাহিনী এর আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে যায়। যুগ্মভাবে ‘এস’ ফোর্স ও বিনা বাধায় সরাইলে পৌঁছায়। সন্ধ্যার মধ্যে একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্বপাশে আজমপুর এবং দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল এবং শাহবাজপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডের দশম বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে সমবেত হয়। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অন্তত তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পূর্বসীমান্ত থেকে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার প্রায় সবকটা বাহিনীই দ্রুত গতিতে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের মূল ভরসারস্থল ছম্বে উপর্যুপরি চেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের অগ্রগতি প্রায় থেমে যায়। অন্যত্রও অবস্থা বেশ খারাপ। রাজস্থান-সিন্ধু সীমান্তে বরং ভারতের প্রাধান্যই পরিলক্ষিত হয়, করাচির ওপর ভারতীয় নৌ ও বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। সংক্ষেপে, পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের কোন অগ্রগতি নেই; আর পূর্বে কেবল পশ্চাৎগতি। যৌথবাহিনীর এ অগ্রগতির ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের সম্যক বিপর্যয় দৃষ্টে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্মকর্তারা নিয়াজির মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ‘চীনের তৎপরতা শুরু হয়েছে’ বলে তাঁকে জানায়। শোচনীয় সামরিক পরিস্থিতির মাঝে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক প্রতিনিধিদের তাঁর শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘদিনের ‘ওয়াদা’ বাস্তবায়ন শুরু করেন এবং পূর্ব-পাকিস্তান থেকে নুরুল আমিন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। সন্ধ্যায় সর্বশেষ সামরিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে ভারতের সরকারী মুখপাত্র ঘোষণা করেন, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই কোন ভূখ- দখলের অভিপ্রায় ভারতের নেই। এই ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে (ওয়াশিংটন সময়) সকাল ১১টায় যখন ডঝঅএ-এর বৈঠক শুরু হয় তখন ঔঈঝ এর জেনারেল রায়ান উপমহাদেশের সর্বশেষ সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন যে, পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রাভিযানের কোন লক্ষণ নেই, বরং পাকিস্তানের অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে রেখেই তারা সন্তুষ্ট রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু ডঝঅএ-এর সভাপতি হেনরি কিসিঞ্জার রায়ানের কাছে জানতে চান পূর্ব রণাঙ্গন থেকে ভারতীয় সৈন্যদের পশ্চিম রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে কত সময় লাগতে পারে। জেনারেল রায়ান জানান, বেশ কিছুদিন; তবে বিমান বাহিত ব্রিগেড তাড়াতাড়িই নিয়ে যাওয়া সম্ভব, পাঁচ বা ছ’দিনের মধ্যেই। তৎসত্ত্বেও এক সম্পূর্ণ নতুন আশঙ্কার অবতারণা করে কিসিঞ্জার বলেন, মূল প্রশ্ন হলো ভারত যদি আজাদ কাশ্মীর দখলের চেষ্টা চালায় এবং পাকিস্তানের বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনীর ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয়, তবে তা হবে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের ইচ্ছাকৃত উদ্যোগ। কিসিঞ্জার আবেগময় ভাষায় সমবেতদের জিজ্ঞাসা করেন, এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এক মিত্রকে সম্পূর্ণ পরাভূত হতে দিতে এবং পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত রাখার জন্য ভারত যদি ভয় দেখায় তা কি আমরা মেনে নিতে পারি? স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি সিস্কো বলেই বসেন, ভারতের এমনতর অভিপ্রায় রয়েছে কিনা তা সন্দেহজনক। তথাপি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের জন্য ‘সামরিক সরবরাহ’ নিশ্চিত করার পক্ষে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আক্ষেপ করে বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব কিছুই আমরা করেছি, কিন্তু সবই দু’সপ্তাহ বিলম্বে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘চলুন সোনার বাংলা গড়ি’ শিরোনামে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, আমার প্রিয় দেশবাসী এবং সহযোদ্ধাগণ, পাকিস্তানী জেনারেলরা উপমহাদেশকে একটি ভয়াবহ যুদ্ধে নিমগ্ন করেছে। গত কয়েক মাস ধরেই এটা পরিষ্কার যে তারা তাদের বোকামি ও পাপের শাস্তিস্বরূপ এরকম একটা সমাপ্তির আশাতেই ছিল। ভারতের প্রতি আগ্রাসন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং ভারত উষ্ণ হৃদয়েই বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। দুই দেশের শত্রু থেকে সৃষ্ট বিপদ থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষকে পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় আরও কাছে নিয়ে এসেছে। আমাদের যোদ্ধারা এখন ভারতের যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের সঙ্গে আমাদের মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এই ছাপ দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধন এটে দিচ্ছে যা বন্ধুত্বের জন্য নির্ধারিত। ভারতের জনগণ সবসময় আমাদের তাদের হৃদয় দিয়ে স্বীকৃতি দিত এবং এখন তাদের সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×