ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনার শর্ত শিথিল হওয়া প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনার শর্ত শিথিল হওয়া প্রয়োজন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার জনকল্যাণে অনেক ভাল ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। তবে বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক উদ্যোগেরই সুফল জনগণ ভালভাবে পায় না। তেমনি একটি পদক্ষেপ হলো বৈদেশিক রেমিটেন্সের ওপর ২% হারে প্রণোদনা প্রদানের উদ্যোগ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে গত ৬ আগস্ট এফআই সার্কুলার ৩১ জারি করা হয়েছে। এই সার্কুলার পাঠ করার পর মনে হয়েছে, সার্কুলারটি সম্ভবত জারি করা হয়েছে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের কথা বিবেচনা করে। এর বাইরেও যে লাখ লাখ বাংলাদেশী উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্ট্যাটাস বা অভিবাসন নিয়ে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত আছেন এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করছেন, তাদের কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে এই সার্কুলার প্রণয়ন করার সময়। তা না হলে সার্কুলারে এমন সব শর্ত রাখা হয়েছে, যা পরিপালন করে উন্নত বিশ্বে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষে প্রেরিত বৈদেশিক রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনা পাওয়া সম্ভব নয়। এই সার্কুলারে দুই ধরনের ব্যাংকের কথা উল্লেখ আছে, যার একটি রেমিটেন্স আরোহণকারী ব্যাংক এবং অন্যটি রেমিটেন্স প্রদানকারী ব্যাংক। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই দুই ধরনের ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারিনি। আমি ঢাকায় কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে যে, তারাও বিষয়টি ভালভাবে জানে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি যখন তাদের কাছে স্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছিলাম যে, আমি যদি আপনার ব্যাংকে এখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করি, তাহলে কে রেমিটেন্স আরোহণকারী ব্যাংক হবে আর কে রেমিটেন্স প্রদানকারী ব্যাংক হবে? আমার এমন প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর তাদের জানা না থাকলেও তারা আমাকে জানাল যে, তাদের ব্যাংকই রেমিটেন্স আরোহণকারী এবং প্রদানকারী ব্যাংক। তাদের এমন দায়সারা গোছের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজে কিছুটা এভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম যে, আমরা যদি সোনালি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ করি, তাহলে সোনালি একচেঞ্জ হবে রেমিটেন্স আরোহণকারী ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংক হবে রেমিটেন্স বিতরণকারী ব্যাংক। কিন্তু যদি জেপি মরগান বা ব্যাংক অব আমেরিকার মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ করা হয়, সেক্ষেত্রে কি হবে সেটি আমার কাছে বোধগম্য নয়। সে যাই হোক, বিষয়টি রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনা প্রদানকারী ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয় বিধায় তারাই সেটি নিশ্চিত করবে। এ কারণে গ্রাহকরা বঞ্চিত না হলেই ভাল। সার্কুলারের শর্ত অনুযায়ী ১৫০০ ডলার পর্যন্ত প্রেরিত রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনা পাবার ক্ষেত্রে কোনরকম কাগজপত্র দাখিল করার প্রয়োজন নেই। তবে এর অধিক যে কোন পরিমাণ রেমিটেন্সের ওপর প্রণোদনা পেতে হলে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে হবে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত নিয়োগপত্রের অনুলিপি। এই শর্তটি মেনে চলা সকলের জন্য, বিশেষ করে যারা উন্নত বিশ্বে বসবাস করেন, তাদের পক্ষে খুবই কঠিন। কেননা আমরা যারা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করি এবং এখানকার কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তাদের পক্ষে নিয়োগপত্রের কপি প্রদান করা এক দুরূহ কাজ। কারণ এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক আগে থেকেই কাগজবিহীন অফিসে পরিণত হয়েছে। এখানে সবকিছু অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়। প্রত্যেক কর্মরত ব্যক্তি সেই প্রতিষ্ঠানের অনলাইনে সবকিছু দেখতে পারে এবং জানতে পারে। এমনকি প্রত্যেকবার বেতনের সঙ্গে যে পে-সিøপ দেয়া হতো, তাও এখন বন্ধ করে ইলেক্ট্রনিক পে-সিøপে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে আমি চাইলেও কোনরকম কাগুজে দলিল খুব সহজে দাখিল করতে পারব না। উন্নত বিশ্বে এখন কাগজপত্র দাখিলের মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বা কর্মরত থাকার বিষয়টি প্রমাণ (ভেরিফিকেশণ) করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন যে কেউ কোন ব্যক্তির নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে ফোন করে তার নামের প্রথম ও শেষ অক্ষর দিয়ে খুব সহজেই সেই ব্যক্তির বিস্তারিত জেনে নিতে পারে। অবশ্য গোপনীয় কিছু বিষয় আছে যেমন, বেতন ভাতা, জন্মতারিখ প্রভৃতি জানার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারী বা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দফতরে দাখিল করার জন্য নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের এইচআর বিভাগ থেকে এক ধরনের প্রত্যয়নপত্র প্রদান করা হয়ে থাকে, তবে সেটি রেমিটেন্স প্রেরণের মতো অতি সাধারণ মানের কাজের জন্য সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। তাই আমরা যারা এখানে বিভিন্ন ব্যাংকে, বৃহৎ কর্পোরেট অফিস বা রিটেইল স্টোরে কাজ করি, তাদের পক্ষে নিয়োগপত্র সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া এখানে চাকরি ছাড়াও অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশী আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকে, যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ টেক্সি বা উবার চালায়। সত্যি বলতে কি এদের প্রকৃত উপার্জন যথেষ্ট সন্তোষজনক এবং তারাই বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করে থাকে। এদের কোন নিয়োগপত্র নেই এবং নেই কোন ব্যবসায়িক লাইসেন্স। তাছাড়াও অনেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে কাজ করে থাকে। আবার অনেকে কাজ না করেও সরকার থেকে ভাল অঙ্কের ভাতা পেয়ে থাকে, যার পরিমাণ একজন সাধারণ চাকরিজীবীর বেতনের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। যেমন, কানাডায় কোন দম্পতির যদি চারজন নাবালক সন্তান থাকে এবং তারা যদি কোন কাজ না করে, তাহলে তারা মাসে প্রায় চার হাজার পাঁচশ’ ডলার চাইল্ড ট্যাক্স বেনিফিট হিসেবে পেয়ে থাকে, যা একজন সাধারণ চাকরিজীবী বেতনও পান না। তারাও মাঝেমধ্যে নানাভাবে সঞ্চয় করে দেশে অর্থ প্রেরণ করে থাকে। কিন্তু বর্তমান সার্কুলারের শর্ত অনুযায়ী তাদের পক্ষে সেই প্রণোদনার সুযোগ লাভ করা সম্ভব নয়। এদিকে কোনরকম কাগজপত্রের ঝামেলা এড়িয়ে প্রণোদনা লাভের সুযোগ রেখে পনেরো শত ডলারের যে বিধান রাখা হয়েছে, তাও দীর্ঘ মেয়াদে একদিকে যেমন লাভজনক হয় না, অন্যদিকে তেমনি প্রকারান্তরে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রেরণকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কেননা, উন্নত বিশ্ব থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাতে গেলে প্রতি রেমিটেন্সের জন্য ন্যূনতম ৬০ থেকে ৮০ ডলার ফি দিতে হয়। তাই কেউ যদি বছরে পাঁচ হাজার ডলার দেশে পাঠতে চায় এবং প্রণোদনা লাভের আশায় পৃথক পৃথকভাবে প্রতিবার দেড় হাজার ডলার করে পাঠায়, তাহলে তাকে তিনবারে কমপক্ষে দুশ’ ডলার রেমিটেন্স ফি প্রদান করতে হবে। অথচ একবারে পাঠালে সে ৪৫০০ ডলারের পরিবর্তে রেমিটেন্স ফি সাশ্রয় করে মোট ৪৭০০ ডলার প্রেরণ করতে পারবে। এই অতিরিক্ত ২০০ ডলারের বিনিময় মূল্য প্রাপ্ত প্রণোদনার চেয়ে প্রায় আট হাজার টাকা বেশি। যদি এক ডলারের বিনিময় মূল্য ৮০ টাকা ধরা হয়, তাহলে একজন প্রবাসী ১৫০০ ডলার করে তিনবার রেমিটেন্স প্রেরণ করে প্রণোদনার টাকাসহ মোট ৩ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ টাকা পাবেন। অথচ সে যদি একত্রে রেমিটেন্স পাঠায়, তাহলে সে ৪ হাজার ৭০০ ডলার পাঠাতে পারবে, যার বিনিময় মূল্য প্রণোদনার অর্থ ছাড়াই দাঁড়াবে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, অর্থাৎ ৮ হাজার ৮০০ টাকা বেশি। এহেন পরিস্থিতিতে উন্নত বিশ্বে বসবাসরত অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশী যে তাদের প্রেরিত বৈদেশিক রেমিটেন্সের ওপর প্রদত্ত প্রণোদনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সরকারের এই মহৎ উদ্যোগের সুফল যেন সকলেই সমানভাবে পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হলে এই প্রণোদনা প্রদানের শর্তগুলো শিথিল করা প্রয়োজন। বিশেষ করে নিয়োগপত্র প্রদানের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পরিবর্তন করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কোন প্রবাসী যদি বিশ্বের বৃহৎ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করে এবং সে যদি উন্নত বিশ্বের কোন দেশের স্ট্যাটাস বা অভিবাসন নিয়ে থাকে, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে নিয়োগপত্র প্রদানের শর্ত খুব সহজেই শিখিল করা যায়। প্রয়োজনে দেশের নাম যেমন, আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে এবং সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বৃহৎ ব্যাংকের নামও উল্লেখ করে দেয়া যেতে পারে। যেমন, কেউ যদি জার্মানি থেকে এইচএসবিসি ব্যাংক বা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ করে, তাহলে তার ক্ষেত্রে পাসপোর্টের কপি ছাড়া আর কোন কাগজপত্রের প্রয়োজন পড়ে না। কেননা, এই শর্তের উদ্দেশ্যই হচ্ছে কেউ যেন অবৈধ অর্থ প্রেরণ করে এই প্রণোদনার সুবিধা নিতে না পারে। উন্নত বিশ্বে স্ট্যাটাস নিয়ে বসবাস করে অবৈধভাবে উপার্জন করা সহজ নয়। বিশেষ ক্ষেত্রে অবৈধ উপার্জন সম্ভব হলেও, তা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করা প্রায় অসম্ভব কাজ। এসব দেশে কোন ব্যাংকে হিসাব খুলতে এবং সেই হিসাবে অর্থ জমা দিতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। এর সঙ্গে কমপ্লায়েন্সের যে বিষয় জড়িয়ে আছে, তা শতভাগ পরিপালন করে থাকে উন্নত বিশ্বের ব্যাংকগুলো। এদের কমপ্লায়েন্সের মান অনেক উন্নত এবং কঠোর। তাই উন্নত ও অধিকতর কঠোর কমপ্লায়েন্সের দেশ ও ব্যাংক থেকে প্রেরিত বৈদেশিক রেমিটেন্সের জন্য নতুন করে কমপ্লায়েন্সের বা ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন পড়ে না। তবে যদি কোন এক্সচেঞ্জ হাঊজ বা অর্থ প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ করা হয়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করার বিধান অবশ্যই থাকতে হবে। প্রণোদনা প্রদান সংক্রান্ত সার্কুলারের বিধানগুলো পরিপালনের ক্ষেত্রে মোটা দাগে যদি দুটো ভাগে ভাগ করে দেয়া যায় অর্থাৎ, অধিকতর উন্নত ও কঠোর কমপ্লায়েন্সের দেশ ও ব্যাংক থেকে রেমিটেন্স গৃহীত হলে প্রণোদনা প্রদানের জন্য নিয়োগপত্রের কপি প্রদানের প্রয়োজন হবে না, অন্যান্য ক্ষেত্রে বিধানগুলো মেনে চলা হবে- তাহলে বিশ্বের যে কোন দেশে বসবাসরত সকল প্রবাসী বাংলাদেশী প্রণোদনা প্রদানের এই উদ্যোগ থেকে সমভাবে লাভবান হতে পারবে এবং অধিকমাত্রায় রেমিটেন্স প্রেরণে উৎসাহিত হবে, যা এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য। লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা [email protected]
×