ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও ৩৪১ পয়েন্ট দিয়ে বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়

প্রকাশিত: ১০:০৭, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯

 হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও ৩৪১ পয়েন্ট দিয়ে বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়

শাহীন রহমান ॥ ঢাকার চার নদীতে দূষিত তরল বর্জ্য পতিত হওয়া বন্ধে আদালত নির্দেশ দিলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রায় ৩৪১ পয়েন্ট দিয়ে এসব বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্যরে মধ্যে পয়োবর্জ্য ও সিটি কর্পোরেশনের দূষিত কঠিন বর্জ্য রয়েছে। এসব দূষিত তরল বর্জ্যরে বাইরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্লুইস গেটের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন এলাকার রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। যা বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া নদীতে চলাচলকারী জাহাজ থেকে পোড়া তেল, মবিল ও এর তীরে গড়ে ওঠা জাহাজ শিল্পকারখানা থেকে দূষিত পদার্থ নদীতে মিশছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর গোলাম রহমান ও বিআইডব্লিউটির সাবেক প্রকৌশলী তোফায়েল আহম্মেদ বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণ নিয়ে একটি জরিপ চালান। এতে দেখা গেছে, ট্যানারি কারখানা, সিমেন্ট, কাগজের মন্ড, টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ব্যাটারি, ডাইং কারখানা, গার্মেন্টশিল্প, মনুষ্যবর্জ্য, শিল্পবর্জ্য, গৃহস্থালির অপরিশোধিত সব বর্জ্যই নদীতে পড়ছে। যদিও সম্প্রতি ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু উপরোল্লিখিত এসব বর্জ্য অব্যাহত পড়ায় বুড়িগঙ্গার দূষণ বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং তা রয়ে গেছে আগের মতোই। বুড়িগঙ্গার দূষণরোধে আদালতের হস্তক্ষেপ নতুন নয়। ২০০৯ সাল থেকে একাধিবার এ বিষয়ে রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত দূষণরোধ সম্ভব হয়নি। গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট তার এক রায়ে বুড়িগঙ্গার দূষণ বন্ধে স্যুয়ারেজের লাইন ছাড়া নদীতে পতিত হওয়া সব লাইন বন্ধে পদক্ষেপ নিতে বিআইডব্লিউটিএকে নির্দেশ দিয়েছে। রায়ে বুড়িগঙ্গায় পতিত ৬৮ স্যুয়ারেজ লাইন ছাড়া আর কোন লাইন থেকে বর্জ্য নদীতে মিশলে সেগুলো বন্ধ করে ৭ জানুয়ারির মধ্যে হলফনামা দিতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই ৬৮ স্যুয়ারেজ লাইন বন্ধের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদন অনুসারে বুড়িগঙ্গায় এখন ৬৮ স্যুয়ারেজ লাইনে বর্জ্য পতিত হচ্ছে। ওয়াসা এর দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাদেরই এটা বন্ধ করতে হবে। এই ৬৮ বাদে বুড়িগঙ্গার দুইপারে জরিপ করে যদি স্যুয়ারেজ লাইন থাকে সেগুলোও ৭ জানুয়ারির মধ্যে বন্ধ করে বিআইডব্লিউটিএকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ অধিদফতর যে ১৮টি বন্ধ করেছে এর বাইরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান আছে কিনা সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে ওয়াসা তাদের দেয়া হলফনামা প্রত্যাহার করেছে। নতুন করে রবিবারের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। ওই দিনই (রবিবার) এ বিষয়ে আদেশ দেবে হাইকোর্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষিত বর্জ্য নদীতে এত পরিমাণে জমেছে যে নতুন করে ঢাকার চার নদী আর বর্জ্য হজম করতে পারছে না। পানি ইতোমধ্যে কুচকুচে আলকাতরার রূপ ধারণ করেছে। পানিও পুঁতিময়। বিআইডব্লিটিএর সাবেক প্রকৌশলী তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, পয়োবর্জ্য স্টর্ম স্যুয়ারেজ বৃষ্টির পানির নিকাশী ব্যবস্থা আলাদা আলাদাভাবে নির্ধারিত। কিন্তু কঠিন বর্জ্যসহ গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য হাসপাতালের বর্জ্য সবই কোন না কোনভাবে পয়ো ও স্টর্ম ড্রেনেজে নিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে নদীর পানিতে অন্যান্য বর্জ্যরে পাশপাশি কলিফর্মের (মানুষের পয়োবর্জ্য থেকে যে জীবাণু তৈরি হয়) মাত্রা খুবই বিপজ্জনক রয়েছে। এই কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিও পানিবাহিত নানা রোগের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার দূষণরোধ কার্যকর বিষদ পরিকল্পনা গ্রহণ এখনই অপরিহার্য। এরূপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় হাঙ্গেরির টেসা নদী মরে গেছে। একই পথে হাঁটছে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালুসহ অন্যসব নদীও। দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে অচিরেই এসব নদীর মৃত্যু ঘটবে। সরেজমিন ঘুরে ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্যুয়ারেজ লাইন ছাড়াও বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা ও কেরানীগঞ্জে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের কারখানা থেকেও বর্জ্য নদীতে পড়ছে। নদীর বুকে প্রতিদিন কয়েক শ’ বড় বড় জাহাজ, ছোট নৌকা, কার্গো চলাচল করে। এসব জাহাজ থেকে নির্গত পোড়া তেল, মবিল, গ্রিজ ও মনুষ্যবর্জ্য অধিকহারে নদীদূষণ করছে। ডাইং কারখানার বর্জ্য, তেজগাঁও শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং ডেমরা ও শ্যামপুরের শিল্প বর্জ্যও সরাসরি নদীতে মিশছে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে স্টর্ম স্যুয়ারেজের মাধ্যমে সড়কের কঠিন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে পড়ছে। এসব বর্জ্যরে সমন্বয়ে পানি এত দূষিত হয়ে পড়ছে যে নদীর গভীর থেকে মিথেন গ্যাস বুদ্বুদ্ উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে, যার উৎকট গন্ধ দূর থেকে নাকে এসে লাগছে। তারা বলেন, মানুষের শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে দেয়ার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে শরীরের দুটি কিডনি। এই কিডনি অচল হলে যেমন দূষিত পদার্থ ছাঁকতে না পারলে শরীরের অভ্যন্তরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তেমনি নদনদী, খালবিল, জলাশয় ইত্যাদিও শহরের কিডনি। দূষিত পদার্থ এতে দ্রবীভূত হয়ে এই পানি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। নদী বাঁচানো আজ সভ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদীর দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করতে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে নদী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। দখল-দূষণরোধে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এমনকি নদীরক্ষায় স্কুল-কলেজের শিক্ষাথীসহ নাগরিক সমাজের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মানুষের নানা কর্মকা-েই দেশের নদীগুলো দূষণ, দখলসহ নাব্য হারাচ্ছে। বেশিরভাগ নদী দখল, দূষণ আর বর্জ্যে এখন মৃতপ্রায়। এছাড়া শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বালু ও বুড়িগঙ্গায় সর্বত্রই চলছে দখলদারদের আগ্রাসী রাজত্ব। তারা বলেন, কলকারখানার তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট ব্যবহারের লক্ষ্যে কারখানা মালিকদের বাধ্য করতে হবে। নৌযান ইঞ্জিনের পোড়া মবিল যেন নদীতে না ফেলা হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। ‘নদী বাঁচাও’ আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক মোঃ আনোয়ার সাদত বলেন, নদী দূষণকারীদেরও করতে হবে। বর্তমানে নদী রক্ষায় একটি অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। কাজেই নদী রক্ষা করে সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে।
×