ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাষন্ড ছেলে ও ছেলে বউয়ের নির্যাতন বৃদ্ধা রাবেয়া তিন বছর ঘর ছাড়া

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

পাষন্ড ছেলে ও ছেলে বউয়ের নির্যাতন বৃদ্ধা রাবেয়া তিন বছর ঘর ছাড়া

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ॥ বৃদ্ধা মা রাবেয়া বেগম তিন বছর বাড়ি-ঘর ছাড়া। আশ্রয় জুটেছে প্রতিবন্ধী মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে। বৃদ্ধ বাবা ইউনুছ গাজী বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে পড়ে আছেন। বাক-প্রতিবন্ধীর মতো অষ্পষ্ট কথা বলার চেষ্টা করেন। অথচ একমাত্র ছেলে মামুন চিকিৎসার নাম করে বাবার প্রায় এক একর জমি লিখে নিয়েছে। বৃদ্ধা রাবেয়া অসুস্থ স্বামীর খোঁজ নিতে নিজের সাজানো বাড়িঘরে গেলে এক মুঠো ভাতও জোটেনি। অন্যের বাড়িতে খেতে হয়। শেষ বয়সে অসহায় এ দম্পতি এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ছেলে মামুন ও ছেলে বউ খাদিজা বেগমের সেবা তো দুরের কথা, জোটেনা খাবার পর্যন্ত। ওদের নির্যতনে জীবন সায়াহ্নে এ বাবা-মা চরম অসহায় হয়ে পড়েছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের মিঠাগঞ্জ গ্রামে বাবা-মায়ের উপর ছেলে ও ছেলের বউয়ের অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বাধ্য হয়ে নিজের ও অসুস্থ্য স্বামীর চিকিৎসা, সম্পত্তি রক্ষা এবং ভরন পোষণের জন্য কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন রাবেয়া বেগম। বিচার চেয়েছেন ছেলের অমানুষিক নির্যাতনের। দুই ছেলে,দুই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল রাবেয়া বেগমের। কয়েকবছর আগে হঠাৎ ঝড়ের মতো বয়ে যায়। হঠাৎ করে মারা যায় বড় ছেলে ফেরদৌস ও মেয়ে আখিনুর। সন্তান হারানোর শোকে স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে যায় স্বামী ইউনুছ গাজী। অসুস্থ্য স্বামী ও ছোট ছেলে মামুনের সংসারে সুখের জন্য নিজের বাবার সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে দোতালা সেমি পাকা ঘর তুলে দেন। ছেলেকে বিয়ে করায়, ছেলে-বউ নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সুখের দিন কাটানোর। বিয়ের পর ছেলের সংসারে সুখের বাতাস বইলেও অসুস্থ্য স্বামীকে নিয়ে রাবেয়া বেগমের জীবনে আসে অমাবস্যার আধার। ছেলে-ছেলে বউর মানসিক নির্যাতনে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে এক পর্যায় ঘর ছাড়তে হয় রাবেয়া বেগমকে। আশ্রয় জোটে বাড়ি থেকে প্রায় সাত কিমি দুরে মেয়ে ফরিদা বেগমের ঘরে। রাবেয়া বেগম জানান, সন্তান হয়ে মামুন সম্পত্তির জন্য জন্মদাতা বাবাকে চাপ দিতে থাকে এবং জমি লিখে দেয়ার শর্তে চিকিৎসা করানোর আশ^াস দেয়। নয় মাস মেয়ের ঘরে থাকার পর গত কুড়ি দিন আগে বাবাকে ফুসলে নিজ বাড়িতে নেয় মামুন। সেখান থেকে চিকিৎসার কথা বলে কলাপাড়ায় নিয়ে সম্পত্তি লিখে নেয়। রাবেয়া বেগমের অভিযোগ, সে নিজে অসুস্থ্য। মেয়ে ও জামাই তাকে বরিশাল নিয়ে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারেন নি। চিকিৎসা না করে ফিরে আসেন। কলাপাড়ায় এসে সাতদিন ছেলের ঘরে থাকলেও ভাত জোটেনি। খেতে হয়েছে অন্যের ঘরে, ঘুমুতে হয়েছে পড়শীর বাড়িতে। এমনকি ভাত খেতে চাইলে মেয়ের বাড়ি থেকে চাল নিয়ে যেতে বলে ছেলে মামুন ও তার বউ। চিকিৎসা সহায়তার কথা বললে সাফ বলা কোন টাকা নেই। অথচ বাবার সম্পত্তি বিক্রির টাকা ছেলে মামুন একটি মোটরসাইকেল কিনেছে। দেয়া হয় তাড়িয়ে। রাবেয়া বেগমের দেবর ইসমাইল গাজী জানান, তার ভাই অসুস্থ্য। কপাল ও মাথায় ঘা, কিন্তু তার কোন চিকিৎসা করাচ্ছে না ছেলে মামুন। অথচ বাবার চিকিৎসার কথা বলে জমি লিখে নিয়েছে। ছেলে বউ খাদিজা বেগম জানান, তিনি তার শাশুড়ির সঙ্গে কোন খারাপ আচরন করেন নি, কিংবা ঘর থেকে বের করে দেয় নি। রাবেয়া বেগম নিজ ইচ্ছায় মেয়ে বাড়ি গেছে। তবে শ্বশুরের সম্পত্তি লিখে নেয়ার পরে তার চিকিৎসা করাচ্ছেন বলে দাবি করেন। রাবেয়া বেগমের মেয়ে খাদিজা বেগম বেগম জানান, তার মা-বাবা তার কাছেই থাকত। ২০দিন আগে হঠাৎ তার বাসা থেকে অসুস্থ্য বাবাকে চিকিৎসার কথা বলে বাসায় নিয়ে যায় ভাই মামুন। কিন্তু মাকে নেয়নি। পরে জানতে জানতে পারে জমি লিখে নেয়ার কথা। অথচ তার বাবার চিকিৎসা হচ্ছে না। ছেলের অত্যাচার সইতে না পেরে নিজের ও স্বামীর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে রাবেয়া বেগম ছেলের বিরুদ্ধে কলাপাড়ার ইউএনওর কাছে দিলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মামুন। তার বাবা তাকে সম্পত্তি লিখে দিয়েছে এবং এই সম্পত্তি দিয়ে সে কী করবেন তা একান্তই তার ইচ্ছা বলে জানায় মামুন গাজী। ইউএনওর কাছে গিয়ে মামুন তার মা-বাবাকে দেখবেন এবং ভরন পোষন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করাবেন এমন মুচলেকা দিয়ে অফিস থেকে বের হলেও মাকে রাস্তায় ফেলেই বাসায় চলে যায় মামুন। মায়ের ওপর সন্তানের নির্যাতনের খবর পেয়ে কলাপাড়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনা পারভিন সীমা ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে তার সামনেই অসুস্থ্য বাবার সঙ্গে অশালীন আচরণ করে মামুন। মামুন গাজী জানায়, তার বাবা তাকে স্বেচ্ছায় জমি লিখে দিয়েছে। তার বাবার চিকিৎসা বালিয়াতলী গ্রামের এক গ্রাম্যডাক্তার দিয়ে করিয়েছেন। এতে সুস্থ্য হয়নি। এখন এক হুজুরকে খবর দিয়েছেন। ঝাড়-ফু দেয়াবেন। কিন্তু মায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে অশোভন আচরনে কথা বলেন। ইউপি চেয়ারম্যান কাজী হেমায়েত উদ্দিন হিরন জানান, বাবার চিকিৎসার কথা বলে মামুন তার সম্পত্তি লিখে নিয়ে এখন কোন চিকিৎসা করাচ্ছে না। মাকে তো বের করে দিয়েছে তিন বছর আগে। তারা স্থানীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। সফল হননি। কলাপাড়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনা পারভীন সীমা বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে। একাধিক গ্রামবাসী ও রাবেয়া বেগমের স্বজন ও পড়শীরা জানান, নিজে ভাতের ফেন খেয়ে, সহায় সম্পত্তি খুইয়ে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন রাবেয়া বেগম । অথচ তিন বছর ধরে সে নিজ ঘরে থাকতে পারছে না। মামুন তার মাকে ঘরে তো তুলছেই না বরং বাবার সম্পত্তিও তার শ্বশুড়ের সহায়তায় লিখে নিয়েছে। এখন কোথায় যাবে এ বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ। তারা দু’জনেই অসুস্থ্য। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান বলেন, এক মা তার কাছে ছেলের বিরুদ্ধে ভরন পোষন না দেয়া ও ঘর থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন। সন্তানের বিরুদ্ধে স্বামীর সম্পত্তি লিখে নেয়ারও অভিযোগ করেন। বিষয়টি জানার পর ছেলেকে ডেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মাকে নিজ বাসায় তুলে নেয়ার জন্য বলেন এবং তাদের চিকিৎসা করাতে বলেছেন। ছেলে যদি তার মাকে ঘরে তুলে না নেয় তাহলে প্রশাসন অসুস্থ্য বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার চিকিৎসার উদ্যেগ নেবে। এছাড়া আগামী বুধবারের মধ্যে বাবার কাছ থেকে লিখে নেয়া সম্পত্তি ফিরিয়ে না দিলে তার বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
×