ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন, ব্রিজ ও রেলক্রসিং

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন, ব্রিজ ও রেলক্রসিং

সম্প্রতি ঘটে গেল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া রেল স্টেশনের কাছে আরেকটি রেল দুর্ঘটনা। তাতে ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে, একটি বগিতে আগুন লেগে যায়। ১২ নবেম্বর ২০১৯ তারিখ মন্দবাগ রেলস্টেশনের কাছে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন আন্তঃনগরের দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন, আহত প্রায় ১০০ জন। খুব মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে অনেক কর্মকর্তা, সচিব, সাবেক মহাপরিচালক অনেক রকম কারণ উল্লেখ করেছেন, কেউ একবার ভুলেও বলেননি রেলওয়ের ঝুঁকিপূর্ণ লাইন, ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ, ঝুঁকিপূর্ণ রেল ক্রসিংগুলোর দুরবস্থার কথা, লাকসাম আখাউড়া সেকশনে ডাবল লাইন স্থাপনের কাজ চলমান থাকায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণ সামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে ট্রেনের সিগন্যাল দেখতে সমস্যা হয়, আবার কেউ কেউ বলেছেন সিগন্যাল ব্যবস্থা সঠিক ছিল না, কেউ বলেছেন রেল লাইনের কাছে গাছের কারণে সিগন্যাল দেখতে অসুবিধা হয়। আবার অনেকে বলেছেন চালক ও সহকারী চালক ট্রেন চালু রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। সিগন্যালিংয়ের বিভিন্ন ত্রুটি ও এর প্রতিকার চেয়ে কয়েক মাস আগেই রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রেলওয়ের চালক সংগঠনের পক্ষ থেকে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন আহমেদকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের কথা, রেলওয়ের সংকেত ও যোগাযোগ বিভাগ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। রেলওয়ে কর্মকর্তারাই বলছেন অনেক জায়গায় হোম সিগন্যাল দেখা যায় না। চালক সমিতি সূত্রে জানা যায় যে, বড়তাকিয়া, মুহুরীগঞ্জ স্টেশনের আপ আউটার গাছের জন্য দেখতে পান না চালক। এছাড়া হাসানপুর, গুণবতী স্টেশনের লুপ লাইন থেকে অ্যাডভান্স স্টার্টার সংকেত দেখা যায় না। সিলেট সেকশনের মনতলা, শাহাজীবাজার, কুলাউড়া, মাইজগাঁও স্টেশনের আউটার হোম সিগন্যাল রেলপথ সংলগ্ন গাছের ডালপালার কারণে দৃশ্যমান হয় না। এজন্য বেশকিছু সেকশনের স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ নির্বিঘœ করতে একাধিক রিপিটার সিগন্যাল বসানোর প্রস্তাব করা হয় সমিতির পক্ষ থেকে। কিন্তু এত সমস্যা নিয়ে রেলওয়ে দীর্ঘদিন কি কারণে জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছিল। কেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জানানো হয়নি, রেলওয়ের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হচ্ছে কিন্তু যে লাইনের ওপর নির্ভর করে রেললাইন এবং মানুষের মহামূল্যবান জীবন সেই রেললাইনের ওপর কারও নজর নেই, রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা কেন চালক সমিতিকে বলতে হবে কেন রেলওয়ের রেল লাইন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য টিম নেই, কেন নিয়মিত চেকিং ছাড়া কয়েক হাজার মাইল ট্রেনলাইন দেশে চরম ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলছে তার কারণ দেশবাসীকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, দেশের মানুষকে জিম্মি করে মৃত্যু কূপে ফেলে দেওয়ার কোন অধিকার আপনাদের নেই, দেশে একটি মাত্র লাইন মাটির ওপর দিয়ে দীর্ঘ শতাধিক বছর আগে ব্রিটিশ শাসকগণ তৈরি করে দিয়েছিল আজ পর্যন্ত তা নতুন করে স্থাপন করা গেল না, সব সময় অন্যের ঘারে দোষ চাপানো হয়, রেল দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালক, গার্ডকে বরখাস্ত করলে কিছুই হবে না। আসল সমস্যা হলো জং ধরা, ঘাসে পরিপূর্ণ নাট বল্টুবিহীন স্লিপার, ট্রেনলাইন দিয়ে চলার সময় রেললাইন মাটি থেকে উপরে উঠে যায়, বাঁশ দিয়ে লাইন সোজা করা হয়, সিলেট-চট্টগ্রাম লাইনে মোট ২০টি ডেথ স্টপ আছে, অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি ব্রিজ আছে যা ইমারজেন্সি ভিত্তিতে তৈরি করা দরকার, তাই অন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে অনতি বিলম্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট সিলেট -চট্টগ্রাম রেললাইন সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি, সকল অরক্ষিত রেল ক্রসিং এ নতুন রেলগেট তৈরি, রেলগেটে একজন সার্বক্ষণিক পাহারাদার নিয়োগ দিয়ে রেললাইনকে নিরাপদ করার পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরী। রেলওয়ের অদক্ষ প্রশাসন, অকেজো চেন অব কমান্ড তা নিশ্চয়ই রেল মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তারা জানেন, তাই দেশের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া রেলওয়ের গতি সঠিক করা যাবে না। জনগণ দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ম্যাগনেটিক ট্রেন চালু হবে, এখন শোনা যাচ্ছে ডাবল লাইন হচ্ছে, নতুন নতুন বগি আসছে বিদেশ থেকে কিন্তু দুর্বল রেললাইনের ওপর দিয়ে রেল চলছে আর দফায় দফায় নিরীহ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে কেন জানি বার বার রবি ঠাকুরের তোতা কাহিনীর কথা মনে পড়ছে, আমাদের অবস্থা ঠিক রবি ঠাকুরের সেই তোতার মতো না হয় সেদিকে একটু খেয়াল রাখবেন। যাদের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ের প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী বাহারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন সেই জনসাধারণকে মৃত্যুকূপ থেকে বাঁচানো না হলে শুদ্ধি অভিযানে মাফ পাবেন না কেউ। লেখক : নিউ ইয়র্ক প্রবাসী
×