ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তৌহিদ বিল্লাহ

নীরব ঘাতক প্লাস্টিক

প্রকাশিত: ১১:৩৯, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

নীরব ঘাতক প্লাস্টিক

পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণসহ ইত্যাদি নানা দূষণের সঙ্গে পলিথিন জাত প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বব্যাপী এখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শব্দ ও বায়ু দূষণের মতো সরাসরি মানবদেহকে আক্রান্ত করে না বলে আমরাও অন্যান্য দূষণের মতো প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে অতটা চিন্তা করি না। অথচ এর ক্ষতিকর প্রভাব মানবদেহে নীরব ঘাতকের মতোই দিন দিন জেঁকে বসতে শুরু করছে। গত কয়েক শতাব্দীতে প্লাস্টিক থেকে তৈরি নানা দ্রব্য আমাদের জীবনযাপনের ধারাকে হয়ত বদলে দিয়েছে। কিন্তু প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার শেষে আমাদের জন্য যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে, সেই ব্যাপারে আমরা জানি না কিংবা জানতেও চাই না। সকালে ঘুম থেকে উঠে টুথব্রাশ দিয়ে আমাদের প্লাস্টিক ব্যবহার শুরু হয়। বালতি, মগ, ঝুড়ি, চেয়ার, টেবিল, পানির পাইপ, সিরিঞ্জ, অটোমোবাইল শিল্পের উপাদান ইত্যাদি আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক দ্রব্যের তালিকা ব্যাপক দীর্ঘ। কিন্তু নিত্য ব্যবহৃত এসব প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষে যখন বর্জ্যে পরিণত হয়, তখন তা নানাভাবে মানবদেহের ক্ষতি করে। তা ছাড়া পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যরে আকার নেয়। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় পুনর্প্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। প্রাকৃতিকভাবে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতেও ৩০০-৪০০ বছর লেগে যায়! তাই একে ‘অপচ্য পদার্থ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশেরও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। সাধারণত উদ্ভিদকুল, জলজ প্রাণী, দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যরে জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ওইসব প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে- ফোমের কাপ, ডিম, মাংস ইত্যাদি রাখার জন্য ব্যবহৃত ট্রে/পাত্র পোড়ালে বিষাক্ত স্টাইরিন গ্যাস নির্গত হয় এবং নিশ্বাসের মাধ্যমে লোমকূপ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। দীর্ঘকাল এই বিষ মানবদেহে প্রবেশ করলে মাথাধরা, ক্লান্তি, দুর্বলতা এমনকি স্নায়ুতন্ত্র বিকল হওয়ার মতো জটিল রোগ দেখা দেয়। তাছাড়াও কত ভাবে যে তা মানব দেহের ক্ষতির কারণ তার তালিকাও বেশ দীর্ঘ। কিন্তু এই ভয়াল দূষণ থেকে বাঁচার উপায় কী? প্রথমত প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। আমরা প্রতিদিন খালি হাতে বাজারে গিয়ে নানা পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরি। এই অপচনশীল ব্যাগগুলো যখন অব্যবহার্য হয়ে যায় তখন ছুড়ে ফেলে আশপাশের পরিবেশকে আমরাই বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। তাই বাজার থেকে এসব পলিথিনসমৃদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগ উঠিয়ে দিয়ে পাট বা পাটজাত চট, কাপড়ের থলে, কাগজের তৈরি ব্যাগ ইত্যাদির ব্যবহার প্রসার ঘটাতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করা যাবে না। অনেকের অজুহাত পাতলা প্লাস্টিক তৈরি বন্ধ করলেই তো সমস্যা মিটে যায়। আসল চিত্র হচ্ছে, দেশে বহু আগেই পলিথিন নিষিদ্ধ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই পলিথিনকে আজও আগলে আছি আমরা। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব পলিথিনের তৈরি ব্যাগ বাজারজাত করেই যাচ্ছে। একদিকে পাটের দ্রব্য তৈরিতে উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে অন্যদিকে এগুলো নিয়ন্ত্রণে আইনকে কঠিনভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে মনিটরিং করতে হবে। একইভাবে বিস্তার করতে হবে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার। আমাদেরও সচেতন হবে মাত্র একবার ব্যবহারযোগ্য এসব পাতলা প্লাস্টিকের তৈরি ক্যারি ব্যাগের ব্যবহার সম্পর্কে। কারণ জেনেশুনে আমরা এভাবে দূষণকে লালন করতে পারি না। তাছাড়া প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের পদ্ধতিও আছে। প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি বা শক্তি উৎপাদন করা যায়। রাস্তা তৈরির কাজেও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা যায়। এক টন প্লাস্টিক দিয়ে এক কিলোমিটার দীর্ঘ আর ৩.৭৫ মিটার প্রস্থ রাস্তা তৈরি করা যায় এবং এতে প্রায় সমপরিমাণ বিটুমিন বাঁচানোও সম্ভব। এ ছাড়া জৈব উপাদান দিয়ে এমন প্লাস্টিক তৈরির কথা ভাবতে হবে যেগুলো সহজেই পচনশীল। এই দিকগুলো নিয়ে সরকারীভাবে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাস্তবায়ন করলে প্লাস্টিক বর্জ্যরে দূষণ থেকে বাঁচার পথ হয়ত বেরিয়ে আসবে। নরসিংদী থেকে
×