ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড় অরণ্যে ঘেরা অনুপম সৌন্দর্যের লীলাভূমি

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯

পাহাড় অরণ্যে ঘেরা অনুপম সৌন্দর্যের লীলাভূমি

রাজুমোস্তাফিজ ॥ সবুজ-শ্যামল আর পাহাড় অরণ্যে ঘেরা বান্দরবান জেলার অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত হ্রদ বগা লেক। ঠিক যেন আমাদের সমতলভূমির মাঝে একটি লেক। চারদিকে পাহাড় গাছ-গাছালি, পাখি আর আবহাওয়া যে কোন মানুষকে বিমোহিত করবে। আশপাশের গ্রামগুলোর মানুষ সহজ-সরল। তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সেই সঙ্গে আধুনিক সমাজের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে চলার প্রাণান্ত চেষ্টা সকলের নজর কাড়ে। পাহাড়গুলো যেন আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজে শ্যামলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাজারও অপরূপ দ্যুতি। যা উপমার অতীত। বগা লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার সাত শ’ ফুট উঁচু পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি লেক। ভূতত্ত্ববিদগণের মতে প্রায় দু’হাজার বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ের চূড়ায় এই লেক তৈরি হয়। মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিন্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এটি। কেওক্রাডাং পর্বতের কোল ঘেঁষে বান্দরবান শহর থেকে ৭০ কি.মি. দূরে রুমা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কি.মি. দূরে বগা লেকের অবস্থান। শান্ত জলের হ্রদ আকাশের কাছ থেকে এক মুঠো নীল নিয়ে নিজেও ধারণ করেছে সে বর্ণিল রং। পাহাড়ের চূড়ায় নীল জলের আস্তর নীল আকাশের সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে এক নৈসর্গিক দৃশ্য। দু’চোখ ভরে দেখা যায় আকাশ, পাহাড় আর জলের মিতালি। প্রকৃতি যেন ঢেলে দিয়েছে একরাশ সবুজের ছোঁয়া। যে কোন পর্যটক থমকে যায় এর অপরূপ রূপ দেখে। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসার ক্লান্তি মুহূর্তে হারিয়ে যায় হ্রদয়ের অতলগহ্বরে। সব কিছু মিলে এ যেন এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বগা লেককে অনেকে ড্রাগন লেকও বলে থাকেন। সকাল, সন্ধ্যা বা রাতে প্রতিবেলায় বগা লেক নতুন রূপে ধরা দেয়। সকালের উজ্জ্বল আলো যেমন বগা লেক দেয় ¯িœগ্ধ সতেজ রূপ। ঠিক তেমনই রাতের বেলা দেখা যায় ভিন্ন এক মায়াবি হাতছানি। রাতের বগা লেক দিনের বগা লেক থেকে একেবারে আলাদা। আর যদি এটি হয় চাঁদনি রাত তাহলে এটি হতে পারে আপনার জীবনে সেরা রাতের একটি। অন্ধকার রাতে পাহাড়ের বুকে চিরে হঠাৎ এক ফালি চাঁদ মৃদু আলোর ঝলক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বগা লেকের শান্ত জলে। দুই হাজার বছর আগের উৎপত্তি হয় বগা লেকের। এর উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত মিথ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বর্তমান যেখানে বগা লেক সেখানে আকাশ থেকে নেমে আসে এক আজব প্রাণী। বিশাল পাখাওয়ালা সেই প্রাণী যখন তখন মুখ থেকে আগুনের হলকা বের করে ধ্বংস করে দিতে থাকে আশপাশের পাহাড়ী ঘরবাড়ি। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গ্রামবাসী। কি করে এই জীবটিকে খুশি করা যায় গ্রামবাসীরা উপায় খুঁজতে থাকে। এক সময় বিশাল পাখাওয়ালা ড্রাগনটি এক চোঙ্গাকৃতির পাহাড়ের গুহায় আস্তানা বানিয়ে নেয়। গ্রামবাসী প্রাণীটির নাম দেয় ‘বগা’। বগাকে খুশি করতে স্থানীয়রা নিয়মিত বিভিন্ন জীবজন্তু ধরে নিয়ে উপঢৌকন হিসেবে পরিবেশন করতে থাকে। এভাবে সময় ভাল কাটছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতেই দেখা গেল গ্রাম থেকে শিশু নিখোঁজ হচ্ছে। প্রথম দিকে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে দোষারোপ করলেও তারা টের পায়, এটি কোন নির্দিষ্ট গোত্রের কাজ নয় বরং সবার সঙ্গেই ঘটছে। এবার সবার সন্দেহের তীর এসে পৌঁছে পড়ে বগার দিকে। বগাকে উৎখাত করতে না পারলে বাঁচানো যাবে না এলাকার শিশুদের। এরপর প্রতিটি গোত্র থেকে বেছে বেছে সাহসী যুবকদের নিয়ে গঠন করা হয় একটি দল। যুদ্ধ করেই হোক আর নিজের জীবন বাজি রেখে ড্রাগনের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েই হোক শিশুদের তারা উদ্ধার করে আনবেই। এই ব্রত নিয়ে যুবকরা ঘর থেকে বের হলো লড়াই করতে। তীর, ধনুক, বল্লম, লাঠি আর মশাল নিয়ে রাতের আঁধারে তারা বগার গুহায় হানা দিল। গুহার মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের রক্ত আর হাড়গোড় দেখে তারা বুঝে নিল কি ঘটেছে এখানে। ক্ষেপে গিয়ে এক সঙ্গে সব যুবক ঘুমন্ত বগার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এতজন যোদ্ধার সঙ্গে বগা পেরে উঠতে না পেরে কোন রকম ঘা ঝারা দিয়ে পালানোর পথ খুঁজতেছিল। যে রথে করে একদিন তার উদয় বগা লেকের পারে সেই রথে উঠে পালানোর চেষ্টা করল বগা। কিন্তু গ্রামের ক্ষিপ্ত যুবকরা বগার রথে আগুন ধরিয়ে দিল। সে আগুনে পুড়ে মরল বগা। তার আগে শেষ বারের মতো মুখ থেকে আগুনের ফোয়ারা ছুটালো। সেই আগুনের তাপে আর প্রচন্ড বিস্ফোরণে থর থর করে কেঁপে উঠল চোঙ্গাকৃতির পাহাড় আর বগার তৈরি করা গুহা। ভেঙ্গে পড়তে শুরু করল পাহাড়, তৈরি হলো বিশাল এক গর্ত। এই গর্তটিই বর্তমানে বগা লেক হিসেবে পরিচিত, যার অপর নাম ড্রাগন হ্রদ। যা আজও মানুষকে আকৃষ্ট করে। প্রতি বছর শত শত পর্যটক এখানে আসে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে।
×