ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুষ্ঠু বিচার, শাস্তিতেই সমাজের কল্যাণ

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯

সুষ্ঠু বিচার, শাস্তিতেই  সমাজের কল্যাণ

ক’দিন ধরে মিডিয়া খুললেই দেখছি শাস্তি আর ফাঁসির খবর। আর তা নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা। কেন এত উত্তেজনাপ্রবণ আমরা? বিচার, শাস্তি এগুলো সমাজে নতুন কিছু নয়। পাপ-পুণ্য এসব যেমন স্বাভাবিক, তেমনি অপরাধও মানুষ এড়াতে পারে না। কিন্তু কেন জানি আমাদের সমাজে সবকিছু মাত্রাছাড়া। এই যে বিচার ও শাস্তি এ নিয়ে এত শোরগোল কেন হবে? যে ঘটনাগুলোর জন্য ফাঁসি হয়েছে সেগুলোর শাস্তি কি এর চেয়ে কম কিছু হওয়ার কথা ছিল? হলি আর্টিজানের ঘটনা কি সাধারণ ঘটনা? দেশের ইতিহাসে এমন জঘন্য হত্যাকা- কবে কখন ঘটেছিল আর? হলি আর্টিজানের ঘটনা সেদিন সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ম্লান করে দিয়েছিল। সে ঘটনার পর বাংলাদেশ এখনও আর তেমন কিছুর মুখোমুখি হয়নি, এটাই আশার কথা। সমান ঘৃণ্য আর ভয়াবহ আরও একটি ঘটনা নুসরাত হত্যাকান্ড। একটি মেয়েকে এভাবে পুড়িয়ে মারা আর যাই হোক সামাজিক সংহতি বা শান্তির প্রমাণ দেয় না। এই ঘটনার জন্য একজন ওসিকে আট বছরের কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। এটাও দৃষ্টান্তমূলক। নুসরাতের মা খাঁটি কথা বলেছেন। এরপর হয়ত আর কোন ওসি সাহেব কোন মেয়েকে প্রশ্ন করবেন না- বুকে হাত দিয়েছিল কি না। কি জঘন্য মানসিকতা! তারচেয়েও প্রকট দাপট। ধরেই নিয়েছিল তারা বাহিনীর লোক। তাদের বিচার বা শাস্তি দেয়ার মতো বুকের পাটা নেই কারও। কিন্তু সবার চেয়ে বড় আইন আর আইনের চেয়ে বড় প্রকৃতির বিচার। তা এড়ানো কি ওসি মোয়াজ্জেমের দ্বারা সম্ভব! প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ন্যায্য ও প্রত্যাশিত বিচার একদিকে যেমন স্বস্তির, তেমনি প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে বেশ কিছু। এই অপারধপ্রবণতা, এই লাগামহীন অপরাধ কতকাল চলবে? দুনিয়ার সব দেশে সব সমাজেই তা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে লাগামছাড়া। কারণ, ইদানীং বিচার হলেও কেউ জানে না শাস্তিগুলো কখন কবে কিভাবে কার্যকর হবে। আদৌ তা হবে কি না। আমরা সাধারণ মানুষ ধরে নেই হবে। যদি সত্যি হয় তাহলে হয়ত এক সময় এ প্রবণতা হ্রাস পাবে। আর একটা কথা, সব সময় মনে হয় লাগাতার ফাঁসি আর সর্বোচ্চ শাস্তি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সমাজকে? সমাজ তো ভাল-মন্দের মানুষ, বারো জাতের মানুষের মিশ্রণ। কেবল কারাগার, কেবল দমন আর বিচার তো জাতির জীবনে মুখ্য হতে পারে না। দেখবেন এই ঘটনাগুলো সামাজিক ও দেশজ মিডিয়াজুড়ে এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, বাকি সব ম্লান হয়ে যায়। অথচ বিশ্বের প্রত্যাশা আর ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে অচিরেই বাংলাদেশ এশিয়ার এক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এই ধারণা অমূলক নয়। কিন্তু এই ধারণা বাস্তবায়ন করতে হলে যে শান্তি আর সমৃদ্ধির প্রয়োজন তা কি এই উত্তেজনায় ভেসে যেতে পারে না? বিশেষত অপরাধীও যখন সামাজিক মিডিয়ায় হিরো! হিরো এই কারণে যে, এদেশের কোন মেহনতি মানুষ, কোন চাষী-শ্রমিক কিংবা গার্মেন্টস কর্মী বা সংস্কতিপরায়ণ কেউ কতকাল লিড নিউজ হয় না? কতকাল তারা পাদপ্রদীপের আলোয় আসে না? সে খবর কি আমরা রাখি? এভাবে চললে নতুন প্রজন্ম কি এটাই জানবে না যে, এদেশ বা সমাজে কিছুদিন পরপর একেকটা এমন ঘটনা ঘটবে আর অপরাধীদের ছবি ভেসে বেড়াবে মিডিয়ায়। একটা বিষয় অবাক করে, মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা যেন এখানে ন্যূনতম। তারা এসব ঘটনাকে যতটা হাইলাইট করে, তার এক ভাগও গুরুত্ব পায় না পজেটিভ নিউজ। বরং বলব সরকার তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করে চলেছে বলেই এত ডামাডোলের ভেতরও বিচার এবং শাস্তির প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। তবে এটাও এখন ভাবার বিষয়, আমরা কি সুস্থ-স্বাভাবিক জাতিসত্তায় আছি? নাকি আমরা ফাঁসিপ্রবণ জাতিতে পরিণত হতে চলেছি? যারা হত্যার মতো গুরুতর নারকীয় অপরাধে জড়িত থাকে তাদের ফাঁসি হোক এটা সবাই চায়। এক বা একাধিক মানুষের জান কেড়ে নেয়া মানুষ কেন বাঁচবে? কেন তার বা তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না? আমরাও চাই। কিন্তু আজ ক’দিন ধরে মিডিয়া খুললেই দেখি ফাঁসির রায়। জানি, সমাজ ও রাজনীতি আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, এর ভাল-মন্দ নিয়েও কেউ এখন ভাবে না। বরং অনেকে বলে ঠিকই আছে। কঠিন শাস্তি না হলে অপরাধ কমবে না। তাও বটে। কিন্তু ভয় হচ্ছে আগামী প্রজন্মের জন্য। কোমলমতি বাচ্চা বা অল্প বয়স্করা এমন সব খবর দেখে বড় হতে থাকলে তাদের মনে কি এর বিরূপ প্রভাব পড়বে না? এর ফলে কি তাদের চিন্তা ও মগজ বিকৃত হতে পারে না? বিশ্বাস করি মাতৃগর্ভে কোন খুনীর জন্ম হয় না। এমনকি ডাকাতের ঘরে যে সন্তান জন্মায় মা-বাবা চায় বড় হয়ে ভাল মানুষ হোক। কোন মা-বাবাই চায় না তাদের সন্তান কুপথে যাক। বা এমন কিছু করুক যাতে তার জীবন নাশ হয়। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, এমনকি দেশ ও জাতিকে পরোয়া না করা এদেরও জন্ম হয় সমাজগর্ভে। তাই সমাজ বদলানো না গেলে এসব কোনকালেও বন্ধ হবে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিও একটা বড় বিষয়। তারা দেশে দেশে, কালে কালে এমন সব কাহিনী আর দানব তৈরি করে যে দানবরা কিছুদিন পরপর নানা নামে নানা পরিচয়ে হাজির হয়। সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি আমরা সবাই চাই। সঙ্গে এও চাই অপরাধপ্রবণতা কমে আসুক। একটাই জীবন মানুষের। মানুষ হিসেবে আমরা যে পৃথিবীর আলো-বাতাস সবুজ মাঠ দেখতে পাই, এটাই তো বড় কৃতজ্ঞতার ব্যাপার। মানুষের জীবনে বিশেষত যৌবনজুড়ে থাকবে প্রেম, সে ভালবাসা নারী দেশ জননী পিতা বন্ধু সবার জন্য হবে। তবেই না মানুষ বাঁচার প্রেরণা পাবে। আমরা কি আমাদের প্রজন্মকে তা দিতে পারছি? রাজনীতি এখন প্রায় বন্ধ্যা। সমাজ অচলায়তন। বাড়ি বাড়ি নেট আর মোবাইলের দাপটে স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মায়া-মমতা এসব এখন কথার কথা। হয়ত এসব কারণেই ভাটি বাংলার মতো কোমল মাটিতে এত কঠিন মানুষের জন্ম হয়, যারা ঠা-া মাথায় মানুষের জান কেড়ে নিতে পারে! শুধু আইন বিচার শাস্তি এগুলো ঠেকাতে পারবে না। সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ রাজনীতি, সঙ্গে সংস্কৃতির প্রসারও প্রয়োজন। [email protected]
×