ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর বায়ুদূষণের শহর

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৯

ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর বায়ুদূষণের শহর

বাতাসের মান নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় সোমবার (১৯ নবেম্বর) থেকে এক নম্বরে রয়েছে ঢাকা। এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ২১২, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। আর দিল্লীর স্কোর ১৯৬, যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে। উল্লেখ্য, প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়। একিউআই সূচকে ৫১ থেকে ১০০ স্কোর পাওয়ার মানে হলো বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর পাওয়ার অর্থ হচ্ছে বাতাসের মান দূষিত। দীর্ঘদিন ধরেই দূষিত বাতাস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা। শুষ্ক মৌসুমে এ শহরে বায়ু দূষণ চরমে উঠলেও বর্ষায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ধুলার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ। মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটি, যানবাহন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার ধোঁয়ার কারণে ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ এক অবিশ্বাস্য বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে বাস করছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঢাকার বায়ুদূষণ মাত্রা কমানোর জন্য জরুরী ভিত্তিতে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সম্প্রতি (গত এক সপ্তাহে) একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের এক নম্বর শহরের জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গড় বায়ু দূষণের পরিমাণ ৯৭ দশমিক ১০, যেখানে পাকিস্তানের ৭৪ দশমিক ২৭, ভারতের ৭২ দশমিক ৫৪, আফগানিস্তানের ৬১ দশমিক ৮০ এবং বাহরাইনের ৫৯ দশমিক ৮০ পিএম২.৫। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য থেকে জানা যায়, ২৪ নবেম্বর ঢাকার বায়ু মান ছিল ২৯৮, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে মূলত অন্যান্য দেশ স্বাস্থ্য-জরুরী অবস্থা জারি করে। বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর ১৯৭ দিন রাজধানীবাসী দূষিত বাতাসে ডুবে ছিল। আগের বছরগুলোতে রাজধানীর বাতাস বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১২০ থেকে ১৬০ দিন দূষিত থাকত। অর্থাৎ ঢাকার বায়ুদূষণ সময়ের বিবেচনায়ও বিপজ্জনকহারে বাড়ছে। বিগত ৪-৫ দিন ধরে বিশ্বে এক নম্বর বায়ু দূষিত শহরের তালিকায় রয়েছে ঢাকা। ১৭ ডিসেম্বর থেকে সচিবালয়ের চারপাশের এলাকা নীরব জোন ঘোষণা ও নিয়মিত পানি ছিটানোসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বায়ু দূষণ বন্ধে অভিযান পরিচালনার কথা বলছে পরিবেশ অধিদফতর। রাজধানীর আশপাশের ইটভাটি, ইচ্ছা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ ও মোটরযানের ধোঁয়ার কারণে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে। গত আট বছর ধরে এই তিন উৎস ক্রমেই বাড়ছে। ফলে বায়ুদূষণ মোকাবেলায় দূষণের উৎস বন্ধ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশের জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারী- বেসরকারী অবকাঠমো ও বিভিন্ন কাজে সমন্বয় করা প্রয়োজন। ঢাকা সিটিতে বায়ুদূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ইউটিলিটি সার্ভিসের কাজের জন্য সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এলিভেটেট এক্সপ্রেস-হাইওয়েসহ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। শহরের বিভিন্ন স্থানে ভবন নির্মাণের সময় পানি ছেটানো, নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে না রাখা ও এগুলো নির্ধারিত বেষ্টনীর মধ্যে আছে কিনা সেটি দেখতে হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বায়ুদূষণের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রাস্তার ফেলে দেয়া বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনার ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ফলে বায়ুদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নির্মাণ কার্যক্রমের বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতিমাসে হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হলো- ইটভাটিতে যাতে পরিবেশ দূষণকারী পদার্থের নির্গমন বন্ধ হয় তা নিশ্চিত করা। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনকে প্রতিদিন সকাল ও দুপুর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ওপর থেকে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা। বিআরটিএ এবং মেট্রোরেল প্রকল্পকেও নিজস্ব উদ্যোগে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা। ইট, বালু, মাটিসহ নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনকারী ট্রাক বা গাড়িকে অবশ্যই ঢেকে মালামাল পরিবহন করে তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ হচ্ছে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিদ্যুত ও তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, শিল্পকারখানা এবং কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া। বায়ুদূষণের আরও একটি কারণ এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের উর্ধে বায়ুম-লের ওজোন স্তরে ক্রমবর্ধমান ফাটল সৃষ্টি হওয়া। মানবজাতি, উদ্ভিদরাজি, পশুপাখি এবং জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর এ্যাসিড বৃষ্টি সংঘটনের মাধ্যমেও বায়ুদূষণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আসছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকা-ের কেন্দ্রগুলোতে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে প্রধানত দুটি উৎস থেকে বায়ুদূষণ ঘটছে- শিল্প কারখানাসমূহ নির্গত ধোঁয়া এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। ইটের ভাটি, সার কারখানা, চিনি কল, কাগজ কল, পাটকল, বস্ত্র কারখানা, স্পিনিং মিল, ট্যানারি শিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, রুটি ও বিস্কুট কারখানা, রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট কারখানা, মেটাল ওয়ার্কশপ, করাত কল প্রভৃতি শিল্প কারখানা প্রধানত বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। এছাড়াও কর্ষিত জমি থেকে উৎপন্ন ধুলা এবং উপকূলীয় দ্বীপসমূহ ও উপকূলীয় ভূমি এলাকায় সন্নিকটস্থ সমুদ্র তরঙ্গসৃষ্ট লবণ কণা দ্বারা বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের এসকল উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধূলিকণা উৎপন্ন হয়, যা কয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের কয়েক প্রকার শিল্প কারখানা যেমন ঢাকা শহরের হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারি কারখানাগুলো প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, এ্যামোনিয়া, ক্লোরিনসহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যেগুলো একদিকে যেমন বিষাক্ত তেমনি অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের বিরক্তি ও পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অধিক হারে নগরায়নের কারণে নগরে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে অধিকতর হারে বায়ুদূষণ ঘটছে। এসকল দূষক মাথাধরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। ধূলিকণা থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণ হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করে থাকে। বায়ুদূষণের কারণে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। বায়ুতে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সীসা নির্গত হচ্ছে। শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নবেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সীসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে সম্প্রতি শিশুদের দেহে সীসা দূষণের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষাকৃত শিশুদের রক্তে প্রায় ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল থেকে ১৮০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল সীসা পাওয়া গিয়েছে যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ৭ থেকে ১৬ গুণ বেশি। অন্যদিকে বায়ুদূষণের ফলে- উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোকের ঝুঁকি, শুক্রাণুর ক্ষতি, কিডনির রোগ, জন্মগত ত্রুটি, হাড়ের ঘনত্ব কমে ফ্র্যাকচার হওয়া, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট এ্যাটাক ইত্যাদি রোগ দেখা দিতে পারে। আবার যক্ষ্মা ও বসন্ত রোগীদের হাঁচি-কাশি থেকে জীবাণু মিশে বায়ুকে দূষিত করে। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেললে ও পায়খানা-প্রস্রাব করলে বায়ুতে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এভাবেও বায়ু দূষিত হয়। আবার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি বানানোর সময় ছোট ছোট ধূলিকণা বায়ুতে মিশে দূষিত করে। দূষিত বায়ু মানুষের শ্বাসকার্যে ব্যাঘাত ঘটায় এবং দেহে নানা রোগ সৃষ্টি করে। দূষিত বায়ুর কারণে মানবদেহে এলার্জি, কাশি, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মাথাব্যথা, ফুসফুসে ক্যান্সার ইত্যাদি মারাত্মক রোগ হতে পারে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যতকে বাঁচাতে হলে দূষণের কবল থেকে বাঁচাতে হবে পরিবেশকে। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×