ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরগঞ্জের এমপি লিটনকে কেন হত্যা করা হলো ?

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

সুন্দরগঞ্জের এমপি লিটনকে কেন হত্যা করা হলো ?

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা ॥ সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী দলীয় প্রয়াত সংসদ সদস্য জননেতা মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন ছিলেন একজন হেমিলনের বংশীবাদক। যার জীয়ন কাঁঠির ছোঁয়ায় পরিবর্তনের উদ্দীপনা স্বাধীনতার চেতনায় কুপমন্ডুকতার প্রভাব বলয় থেকে আলোর দীগন্তে উদভাসিত হয়েছিল সুন্দরগঞ্জের মানুষ। কিন্তু এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধবাদি মানুষরা প্রাণবন্ত এই মানুষটিকে বেশিদিন বেঁচে থাকতে দেয়নি। পূরণ হতে দেয়নি তার মানুষের কল্যাণে পরিকল্পিত স্বপ্ন বিলাসকে। নির্মমভাবে তার বাড়িতেই পরিবার-পরিজনের সম্মুখেই তাকে হত্যা করা হয়েছে রিভলবারের গুলিতে। সুন্দরগঞ্জের সর্বানন্দ ইউনিয়নের মাস্টারপাড়া গ্রামের তৃণমুল থেকে বেড়ে ওঠা একজন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। ছোট বেলা থেকেই তিল তিল করে স্বাধীনতা এবং গণ মানুষের কল্যাণ চেতনায় নিবেদিত এই মানুষটি একদিন সবার স্নেহ ভালবাসায় নির্বাচিত হয়েছিল গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের জাতীয় সংসদের সদস্য। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলসহ ১টি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গড়ে ওঠা সুন্দরগঞ্জ উপজেলার অবহেলিত পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণ কামনার প্রবল আকাংখা থেকেই তিনি ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের সাথে এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। প্রথমেই তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হিসেবে শুরু করেন তার এই রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্পৃক্ত হওয়ার পথযাত্রা। সেসময় সুন্দরগঞ্জ এলাকার অধিকাংশ মানুষ ছিল জামায়াতে ইসলামীর আদর্শের অনুসারী। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের প্রভাব সুন্দরগঞ্জে ছিল অনেকটাই ক্ষীণ। ফলে স্বাধীনতা ও উন্নত চেতনার মন মানসিকতার মানুরাই ছিল অনেকটা চাপের মুখে কোণঠাসা। এই অবস্থা থেকে সুন্দরগঞ্জে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সুত্রপাত ঘটান মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা জনতার ব্যানারে সুন্দরগঞ্জের গোটা এলাকায় সভা, সমাবেশ, মিছিল মিটিংয়ের মাধ্যমে নতুন চেতনায় মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে শুরু করেন। ২০০০ সালের ২৬ জুন জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে সুন্দরগঞ্জ কলেজ মাঠে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। জামায়াতের সেসময়ের সবচাইতে প্রভাবশালী আমীর ও রাজনীতিবিদ গোলাম আজম ছিলেন সেই সভার প্রধান অতিথি। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন পন্ড কওে দেন। গোলাম আজমকে নিয়ে অনুসারীরা সভা থেকে পালিয়ে যান। এই ঘটনা নিয়ে যদিও তাকে কোন কোন সেক্টর থেকে সমালোচনাসহ মামলা মোকদ্দমার জটিল আবদ্ধে পড়েন। তার পরেও তিনি জামায়াত বিরোধী এই আন্দোলন থেকে কখনও পিছপা হননি। তার এবং তার অনুসারীদের লাগাতার প্রচেষ্টা এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরগঞ্জের স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষ আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সম্পৃক্ত হয়ে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রটির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ফলশ্র“তিতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সংঘবদ্ধ ঘাঁটিতে পরিণত হয় এবং মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সর্বস্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর ভোটে সুন্দরগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা বিরোধী এই অশুভ চক্রটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের রাজনৈতিক জীবনাচরণ কখনই ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। এর পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল তার দলেরই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। নানা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে তাকে আত্মরক্ষা করে চলতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক গোপন হত্যার চক্রান্ত সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি রক্ষা পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি নানা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে তার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে নানা কলংক রটিয়ে তাকে সবসময় বিপদে ফেলানোর পরিকল্পিত অপচেষ্টাও অব্যাহত ছিল। অবশেষে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রটির সকল অপচেষ্টা স্বার্থকতায় পরিণত হয়। অতঃপর তার দলীয় এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে স্বাধীনতা বিরোধীদের গোপন চক্রান্তের ফলশ্র“তিতে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা সম্ভব হয়। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর আকাশে যখন গোধুলির রং ছড়িয়ে পড়ছিল, পাখিরা ডানা মেলে ফিরছিল নীড়ে আর মসজিদে মসজিদে ধ্বনিতে হচ্ছিল মাগরিবের আযানের ধ্বনি। সেসময় এমপি লিটন তার প্রিয় ঘরের সামনের গাব গাছ তলায় বসে সামনের মাঠেই ছোট ছেলেদের খেলা দেখছিল। ঠিক সেসময় তিন দুর্বৃত্ত একটি মটর সাইকেলে তার সামনে আসে এবং একজন মটর সাইকেলে বসে থাকে। আর অপর দু’জন তাকে আলাপ করার কথা বলে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। ঘরের মধ্যে যাওয়ার সাথে সাথেই ঘাতক দু’জন তার উপর রিভলবারের ৬ রাউন্ড গুলি চালায়। ক্লোজ রাউন্ড থেকে ছোড়া এই গুলির মধ্যে তাকে পাঁচটি গুলি বিদ্ধ করে। এভাবেই নির্বিঘেœ হত্যাকান্ড সম্পন্ন করে তারা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে ওই মটর সাইকেলে চড়েই পালিয়ে যায় ঘাতকরা। এতদসত্ত্বেও ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে এমপি লিটন বাঁচার জন্য চিৎকার করে। তাকে সাথে সাথে নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ওইদিন রাত সাড়ে আটটায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ চক্রান্তকারী চক্রের কাছে এমপি লিটনের ধীরে ধীরে মজবুত ভিত্তির উপর জনপ্রিয় নেতা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া কিছুতেই কাংখিত ছিল না। এ কারণেই সুন্দরগঞ্জের রাজনীতি থেকে দ্রুত তাকে সরিয়ে দেয়া। আর এই উপজেলার মানুষকে কুসংস্কার আচ্ছন্ন ও উন্নয়ন বঞ্চিত রাখতে আবারও গ্রাস করে ফেলা। লিটন হত্যার মধ্যে দিয়ে যা তারা অনেকটাই সফল করতে সক্ষম হয়েছে। যদি অপতৎরতাকারী চক্রটির সুদুর প্রসারী এই অশুভ চক্রান্ত সার্থক হওয়ার সুযোগ পায়। তবে অবহেলিত এই জনপদের জন্য লিটনের এবং তার অনুসারিদের কষ্টার্জিত এবং সংগ্রামী কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত যে অর্জন। তা ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হবে। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের এই চক্রান্ত সার্থক হলে জননেতা লিটনের বিদেহী আত্মাও কষ্ট পাবে। কেননা তার একমাত্র স্বপ্নই ছিল সুন্দরগঞ্জের কল্যাণ। সুতরাং অবহেলিত সুন্দরগঞ্জের পিছিয়ে পড়া মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে শানিত করে তুলতে এই হ্যামিলনের বংশীবাদক যে চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। যে উদ্দীপ্ত আহবানে জনকল্যাণে ঐক্যবদ্ধভাবে চেতনাদীপ্ত করেছিল মানুষকে।
×