ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জ্বালানি ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন

ডিজেল আমদানি কমেছে ১৪ লাখ টন

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২৩ নভেম্বর ২০১৯

ডিজেল আমদানি কমেছে ১৪ লাখ টন

রশিদ মামুন ॥ দেশে জ্বালানি ব্যবহারের ধরনে বড় পরিবর্তন এসেছে। পরিবহন এবং সেচে জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বিদ্যুতের ব্যবহারে বছর ব্যবধানে ডিজেল আমদানি কমছে ১৪ লাখ মেট্রিকটন। এতে অন্তত আট হাজার ৪০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ হবে নির্মল। বিপিসি সূত্র বলছে, দেশে গত বছর ডিজেল আমদানি হয়েছে ৪৬ লাখ টন। এবার হবে ৩২ লাখ টন। এক সঙ্গে ১৪ লাখ টন ডিজেলের আমদানি কমাকে বড় বিষয় বলে মনে করা হচ্ছে। বিষয়টিকে দেশের জ্বালানি ব্যবহারে বড় পরিবর্তন বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো পরিবেশের কথা চিন্তা করে ডিজেল ব্যবহার কমিয়েছে। সেখানে দেশে ডিজেলের ব্যবহার কমার যে ধারা তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ক্রমান্বয়ে ডিজেল ইঞ্জিনের বদলে ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহার করছে। ইউরোপের অনেক দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ডিজেল ইঞ্জিনের বদলে ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে আমাদের দেশে এখনই এই যাত্রা শুরু করা কঠিন। এখন নতুন আমদানি করা গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে সরকার হাইব্রিড প্রযুক্তিতে কর ছাড় দিচ্ছে। হাইব্রিড গাড়ি ব্যাটারি এবং তরল জ্বালানিতে চলার কারণে সাশ্রয়ী। যাতে তরল জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করছে। তবে দেশের গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুত চালিত যানের বিস্তার ঘটলেও শহর পিছিয়ে রয়েছে। কেন হুট করে একবারে এতটা ডিজেলের আমদানি কমেছে জানতে চাইলে বিপিসি চেয়ারম্যান মোঃ সামছুর রহমান বলেন, ডিজেল প্রধানত ব্যবহার হয় পরিবহন এবং সেচে। দুই জায়গাতে মূলত জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের ব্যবহার কমেছে। পাশাপাশি সরকার বিদ্যুত উৎপাদনেও ডিজেলের ব্যবহার অনেকটা বন্ধই করে দিয়েছে। ফলে দেশে ডিজেলের চাহিদা কমছে। তিনি বলেন, এক সময় গ্রামে পরিবহনে যে ডিজেল ব্যবহার হতো এখন সেখানে ইলেক্ট্রিক যান এসেছে। ফলে ডিজেলের চাহিদা কমেছে। এছাড়া নতুন নতুন এলাকা বিদ্যুতায়িত হচ্ছে। এতে সেচ কাজেও ব্যাপকভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে যা দেশে ডিজেল কমার আরেকটি কারণ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই দুই কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজেল চালিত বিদ্যুতের উৎপাদন কমানো। সরকার ডিজেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে এই কারণেও দেশে ডিজেলের ব্যবহার কমেছে। দেশে ডিজেলে এক ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যয় হয় ২৭ টাকা ২১ পয়সা। এর মধ্যে জ্বালানি খরচই সর্বোচ্চ প্রয়োজন পড়ে ১৪ টাকা ৯২ পয়সা। দেশে অন্য তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্রে এর অর্ধেক ব্যয়ে বিদ্যুত উৎপাদন হয়। ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালানো কেন্দ্রগুলোতে ১৩ টাকা ৬২ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন করে। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনকে বেশি আর্থিক ক্ষতির কারণ মনে করে কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, অতীতে গ্যাসের সঙ্কটের কারণে ২০১৩ সাল থেকে দেশে দ্বৈত জ্বালানির বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো ডিজেলে চালানো হতো। কিন্তু গত বছর এলএনজি আনার পর থেকে এসব কেন্দ্র গ্যাসে চলছে। ফলে বিপুল পরিমাণ ডিজেল সাশ্রয় হয়েছে। যা দেশের ডিজেল ব্যবহার কমার আরও একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল ব্যবহার নিম্নমুখী হওয়ার এই ধারা ধরে রাখতে হবে। এখন এর বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌরশক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। গাড়ির জ্বালানিতে বিদ্যুত ব্যবহারের পাশাপাশি এলপিজিও ব্যবহার করা যেতে পারে। যা ডিজেলের চেয়ে দামে কম এবং পরিবেশবান্ধবও। বিপিসির জন্য কিভাবে বিষয়টি লাভজনক জানতে চাইলে বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি জাহাজে বিদেশ থেকে ৩০ হাজার টন তেল আসে। আর এই তেল আনতে খরচ হয় ১৮০ কোটি টাকা। এই হিসাব ধরে ১৪ লাখ টনের জন্য প্রয়োজন হয় আট হাজার ৪০০ কোটি টাক। ফলে এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আর ডিজেল আমদানির জন্য প্রয়োজন হবে না। ডিজেল আমদানিতে অর্থের সাশ্রয় হলেও এলএনজি আমদানিতে তা ব্যয় হচ্ছে। তবে জ্বালানির বহুমুখীকরণের ফলে কিছুটা অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির জ্বালানি হওয়াতে এলএনজিতে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না বললেই চলে। ডিজেলে কিভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয়ু কমছে বাংলাদেশের মানুষের। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই দূষণ সবচেয়ে বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এর ক্ষতিকর প্রভাবে। বর্তমানে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রাজধানী ঢাকা। এই দূষণের একটি বড় অংশ হয় ডিজেলের কারণে। ডিজেল পোড়ালে যেসব বস্তুকণা পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, জৈব বিষ-পলিনিউক্লিয়ার এ্যারোমেটিক্স। চিকিৎসকরা বলছেন, ক্ষুদাতিক্ষুদ্র এসব কণা ফুসফুসের কোষের ভেতরেও ঢুকে যেতে পারে। ফলে সাধারণ মানুষের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট থাকলে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। অন্যদিকে দীর্ঘদিন এই দূষণের শিকার হলে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ডিজেলের ব্যবহার কমা আমাদের পরিবেশের জন্য একটি সুখবর। আমরা মধ্যম মানের ডিজেল কিনি। একেবারে কম সালফারযুক্ত ডিজেলের দাম অনেক বেশি। যার ব্যয় আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। তিনি বলেন, আমরা যত কম ডিজেল পোড়াব ততই বায়ুর দূষণ কম হবে।
×