ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে-বাইরে চাপের মুখে ॥ তারেকও রাজি না

জামায়াত ছাড়তে পারছে না বিএনপি

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৯

 জামায়াত ছাড়তে পারছে না বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপির ওপর নানামুখী চাপ থাকলেও তা আমলে নিচ্ছে না দলীয় হাইকমান্ড। দলের একটি বড় অংশও এখন জামায়াতের কাছ থেকে দূরে সরে আসার পক্ষে। কিন্তু লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজি না থাকায় জামায়াত ছাড়তে পারছে না বিএনপি। এ কারণে ঘরেবাইরে চাপের মুখে দলটি। সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির ওপর জামায়াত ছাড়ার চাপ বাড়ে। দলের ভেতর থেকেও একটি বড় অংশ জামায়াত ছাড়ার দাবি জোরদার করে। এ ছাড়া বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও জামায়াত ছেড়ে নতুন উদ্যমে রাজনীতি করার পরামর্শ দেয় বিএনপিকে। এ পরিস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বেশ ক’টি বৈঠকেও জামায়াত ছাড়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। কিন্তু লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জামায়াতের ভোটব্যাংক ও মাঠের রাজনীতির শক্তিকে বিবেচনায় নিয়ে জামায়াত ছাড়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন না। আর এ কারণেই ঘরে-বাইরের চাপ উপেক্ষা করে এখনও জামায়াতকে সঙ্গী করেই রেখেছে বিএনপি। জানা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এক অনুষ্ঠান মঞ্চে তৎকালীন জামায়াত নেতা গোলাম আজমের পাশে বসেন তারেক রহমান। এ সময় তারা উভয়ে উভয়ের প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন। এরপর থেকে জামায়াতের সঙ্গে ধীরে ধীরে তারেক রহমানের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে অবস্থানকারী বিএনপি নেতারা জামায়াতকে অনেক কম আসনে ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন দিতে চাইলেও পরে তারেলক রহমানের নির্দেশে তাদের ২৫টি আসন দেয়া হয়। অপর এক সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যখন কারাগারে। তখন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতারা। ওইসময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির কার্যক্রম চালানোর মতো অবস্থা ছিল না। এ পরিস্থিতিতে জামায়াত এগিয়ে আসে বিএনপিকে সহযোগিতা করতে। তারা বিএনপির যে কোন কর্মসূচীতে আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াও কর্মসূচী সফল করতে বিপুলসংখ্যক জামায়াত নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটায়। এ কারণে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান জামায়াতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন। আর এ জন্যই বিএনপির ওপর জামায়াত ছাড়ার যত চাপই আসে তারা তা অকপটে সহ্য করে যায়। মাঝে মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কিছুটা মান-অভিমানের ঘটনা ঘটলেও তা দ্রুত আবার মিটে যায়। রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা জামায়াত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কৌশলে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো দলটি নতুন করে নিবন্ধন পাওয়ারও জন্য বিএনপি ছাড়ার ধোয়া তুলে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালায় বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করছে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। কোন অবস্থাতেই বিএনপি ছাড়বে না জামায়াত। আবার বিএনপিও জামায়াতকে হারাতে চাইবে না। তাই প্রকাশ্যে বিএনপির সঙ্গে তেমন মেলামেশা না করলেও গোপনে ওই দলের সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ রক্ষা করেই চলছে জামায়াত। পর্যবেক্ষকদের মতে জামায়াতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই। অভিজ্ঞ মহল মনে করছে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপিকে ছেড়ে দেয়ার কথা শুনলে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকার খুশি হবে এমন একটি চিন্তা থেকে জামায়াত মাঝেমধ্যে তা করছে। কিন্তু বাস্তবে জামায়াত ও বিএনপি কেউ কাউকে ছাড়বে না। কারণ এ দু’টি দল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে আওয়ামী লীগ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি যখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলে তখন বিদেশী কূটনীতিকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু বিএনপি এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বরং জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার চাপ দেয়া হয়। জামায়াতকে খুশি রাখতেই তখন বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। তা না হলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সভাপতি অধ্যাপক বি চৌধুরীকেও তারা এ জোটে রাখতে পারত। আর তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এমন ভরাডুবি হতো না বরং শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারত বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে মাঠের এবং ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত ছাড়া কার্যত অচল বিএনপি। আবার বিএনপি ছাড়া জামায়াতও অচল। তাই এ দু’টি দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের গাটছাড়া সম্পর্ক। জোটসঙ্গী জামায়াত ছাড়া বিএনপির কোন কর্মসূচীই সফল হয় না তা বিগত ১০ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। আর এ জন্যই জামায়াতকে খুশি রাখতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট হলে জামায়াত ছাড়া ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলই মেনে নেয়ার পক্ষে ছিল। তবে বি চৌধুরীর শর্ত অর্থাৎ জামায়াত বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত বেঁকে বসতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে বিএনপি বি চৌধুরীকে বাদ দিয়েই জোট করে। আর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে ন্যাপ ও এনডিপি। পরে বিজেপিসহ আরও ক’টি দল জোট ছেড়ে যায়। তবে বিএনপি ওই দলগুলোর কিছু ড্যামি নেতাকে দিয়ে নতুন দল গঠন করে ২০ দলীয় জোটে দলের সংখ্যা ঠিক রাখে। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০০ সালে জামায়াতের সঙ্গে মিলে ৪ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। এ জোটের অধীনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে গিয়ে জামায়াতকেও ২ টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেয় বিএনপি। এর ফলে তৎকালীন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগানোর সুযোগ পায়। তবে বিএনপি মুখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা বলে কিভাবে ২ জন চিহ্নিত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী বানায় এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের ওই ২ শীর্ষ নেতাসহ বেশ ক’জনের ফাঁসি হওয়ায় বিএনপি ও জামায়াত দেশে-বিদেশে চরম সমালোচনার শিকার হন। তারপরও এ দু’টি দল নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন আরও জোরদার করে। এদিকে গত কয়েক মাস আগে বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার দাবি জোরালো হলে জামায়াতের মধ্যে আশঙ্কা হয় শেষ পর্যন্ত তারা ২০ দলীয় জোটে থাকতে পারবে কি না। এমন অবস্থায় ২০ দলীয় জোটের শরিক দল এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদকে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম মুক্তি মঞ্চ গঠন করায় জামায়াত। এ জোটের সঙ্গে জামায়াতও থাকে। অলি এ মঞ্চের আহ্বায়ক হলেও জামায়াতই বিভিন্নভাবে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ পরিস্থিতিতে আবারও বিএনপির জামায়াত প্রীতি বেড়ে যায়। কিন্তু জামায়াত নেতারা আগের মতো বিএনপিকে পাত্তা না দেয়ায় বিএনপিও নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তারা অলির দল এলডিপি নেতা আব্দুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমকে দিয়ে এলডিপিকে ব্রাকেটবন্দী করে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর থেকেই চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত। তারা এখন প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারছে না। তবে গোপনে সারাদেশের সকল পর্যায়ে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছে দলটি। সম্প্রতি দলের নতুন আমিরও নির্বাচন করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছু বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতকে ছেড়ে দিলেও বিএনপির কোন লাভ হবে না। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গেলে সমমনা সব দলেরই সমর্থন প্রয়োজন। তাই মাঠের রাজনীতি ও ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে দলীয় হাইকমান্ড জামায়াত ছাড়তে চান না। আর জামায়াতও কোন অবস্থাতেই বিএনপি থেকে দূরে সরে যেতে চায় না। আরেক বিএনপি নেতা বলেন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী চায় ২০ দলীয় জোটে জামায়াত না থাকুক। আর এটি বুঝতে পারে বিএনপিও সতর্ক রয়েছে। যে কোন দলের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করতে কোন বাধা নেই। তাই বিএনপি জামায়াতকে জোটে নিয়েছে। আপাতত জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
×