ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাছের কথা দূরের কথা

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২২ নভেম্বর ২০১৯

কাছের কথা দূরের কথা

সত্তরের দশকের অনিশ্চিত দোলাচালে কাজী এনায়েত উল্লাহ উচ্চশিক্ষা গ্রহণে পাড়ি জমান সুদূর প্যারিসে। তখন ১৯৭৮ সাল। পড়াশোনা শেষে দীর্ঘ চার দশক তিনি প্যারিসেই আছেন। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও লেখক মন নিয়ে এ শহরকে তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে তার ঝুলিতে সঞ্চিত হয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এর আলোকেই তিনি লিখেছেন ‘বিশ^প্রবাস’ গ্রন্থটি। কাজী এনায়েত উল্লাহ বইটির প্রসঙ্গ কথায় লিখেছেন, ‘আমিও পেয়েছি অনুসরণীয় রাষ্ট্র এবং শুদ্ধ সুন্দর মেধাবী মানুষ। আমিও পেয়েছি পরম বন্ধু এবং মহৎ মানুষের সঙ্গ ও সান্নিধ্য। চলতে চলতে পথ ও প্রান্তর থেকে আমি যা শিখেছি, আমি যা কুড়িয়ে পেয়ে নিজেকে সাজিয়েছি সবার জন্য; আমার সে অভিজ্ঞতা ভাললাগা-ভালবাসার কথা লিখেছি পাঠক এবং স্বপ্ন জাগানিয়া প্রজন্মের জন্য।’ বিশ^প্রবাসের রচনা শুরু হয়েছে ঢাকা থেকে প্যারিস যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তগুলো ধারণ করে। প্রবাসে যাওয়ার পূর্বে প্রতিটি মানুষেরই মন নিজ দেশ ও স্বজনদের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কাজী এনায়েত উল্লাহও তার ব্যতিক্রম নন। যেহেতু তার একটি লেখক মন রয়েছে, তাই প্রস্থানের বেদনা তাকে আরও গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে। পরবাসে পাড়ি দিতে গিয়ে বুকের ভেতর তাঁর ‘কষ্টের বাঁশি’ বেজেছে। আবার নতুনের আনন্দেও তিনি উজ্জীবিত হয়েছেন। আলোচ্য গ্রন্থের ‘বনানী থেকে প্যারিস : আনন্দ বেদনার ঘনঘটা’ রচনার পুরোটা জুড়েই রয়েছে এমন সুখ-দুঃখের বিচিত্র অনুভব। প্যারিসে পৌঁছে লেখক সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ‘প্যারিসের সেই সব দিনগুলি রাতগুলি’ রচনায়। পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনসংগ্রাম এবং প্যারিসকে কাছ থেকে দেখার বর্ণনা এ রচনায় তুলে ধরা হয়েছে। খুব দ্রুতই তার আপন হয়ে যায় স্বপ্নের শহর প্যারিস। কাজী এনায়েত উল্লাহ লিখেছেন, ‘প্যারিসে বেড়াতে আসা হাজার হাজার বিদেশী পর্যটককে দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। কত দেশ থেকে কত মানুষ যেখানে বেড়াতে আসে, আমি সেখানে সেই শহরে থাকি। আমার এই প্রবাসবাস নিয়ে গর্ব করতেই পারি। ঢাকার পাশাপাশি আমি এখন প্যারিস মহানগরী নিয়েও গর্ব করতে পারি।’ রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র, জাতি থেকে জাতির যে পার্থক্য তা পরোক্ষভাবে ‘বিশ^প্রবাস’ বইয়ে আলোচিত হয়েছে। ফরাসীরা কোন কাজকেই ছোট করে দেখে না। কাজ তাদের কাছে কেবল কাজ হলেও বাংলাদেশে এমন উপলব্ধি এখনও গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়াও লেখক উপলব্ধি করেছেন ফ্রান্সে সন্তান জন্ম দেন মা-বাবা, কিন্তু সন্তানকে মানুষ করে রাষ্ট্র। অন্যদিকে বাংলাদেশে সন্তানের প্রায় সকল দায়-দায়িত্ব পিতা-মাতার। লেখক মনে করেন, শিশুরা পবিত্র সুন্দর। তাদের মধ্যে ভেদাভেদ হওয়া উচিত নয়। সকল শিশুই রাষ্ট্রের সম্পদ। তাই জন্মের অধিকারে শিশুকে শ্রমমুক্ত হতে হবে। এমন উপলব্ধি কেবল লেখকের একার নয়, এ অনুধাবন সচেতন প্রতিটি মানুষের। ‘বিশ^প্রবাস’ পড়ে মনে হয়েছে গ্রন্থ রচয়িতার রয়েছে সূক্ষ্ম বোধসম্পন্ন কোমল অনুভব। খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ও তার দৃষ্টি এড়ায় না। বরং অনালোকিত বিষয়গুলোই তিনি যেন দেখতে পান বিশেষ মহিমায়। সে কারণে লেখক বার বার শৈশব-কৈশোরের জীবনস্মৃতিতে আপ্লুত হয়েছেন। নিপুণ ব্যঞ্জনায় মনে হয়েছে ‘চিরচেনা প্রতিবেশী বাড়িঘরগুলো’ তার আত্মীয়তুল্য। একই সঙ্গে লেখকের দার্শনিক সত্তার পরিচয়ও বিভিন্ন রচনায় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘সবার ভেতরেই একজন নিজস্ব মানুষ থাকে। সেই একান্ত আমি মানুষটির সঙ্গে কথা আমার হয়? অন্যকে ভালবাসার আগে সেই নিজস্ব মানুষটিকেও ভালবাসতে হয়।’ ‘বিশ^প্রবাস’ বইয়ে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন (আয়েবা) প্রতিষ্ঠা, কার্যক্রম ও সাফল্য; ইউরোপে বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের পোশাক চালু, ফ্রান্সে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার স্থাপনে লেখকসহ অন্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থের অন্য রচনাগুলোও তাৎপর্যবহ। গ্রন্থের বিভিন্ন রচনায় কবিতার ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যক্তিক গূঢ়তর উপলব্ধিকে প্রকাশ করতে বিশে^র প্রখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকের চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঝরঝরে ভাষায় লিখিত ‘বিশ^প্রবাস’ প্রকাশিত হয়েছে শব্দশৈলী প্রকাশনী থেকে। প্রকাশ সাল বইমেলা ২০১৯। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার রবিশঙ্কর মৈত্রী। প্রচ্ছদ করেছেন সোহেল আনাম। ১২৮ পৃষ্ঠা। মূল্য ৩০০ টাকা। গত জুলাই মাসে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ^প্রবাস পাওয়া যাবে রকমারি ডটকমে।
×