ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনোপনীয় বিদ্যাসাগর

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২২ নভেম্বর ২০১৯

অনোপনীয় বিদ্যাসাগর

যে জাতির ইতিহাস নেই, সে জাতি সমৃদ্ধ নয়, যে জাতির কোন অতীত ইতিহাস নেই, সে জাতির কোন বর্তমান ইতিহাসও নেই। বাঙালী জাতির ইতিহাস কতখানি যে সমৃদ্ধ তা ইতিহাসের পাঠ ছাড়া বোঝা যায় না। আচর-রীতি-সংস্কারে এ জাতিকে কতখানি যে পথ ডিঙাতে হয়েছে, তা অধ্যায়ন ছাড়া কল্পনা করাও কঠিন। আর এ ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি অলোপনীয় নাম বিদ্যাসাগর, তাঁকে নিয়েই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সৈয়দ আবুল হোসেন লিখেছেন ২১৪ পৃষ্ঠার একটি অনবদ্য বই বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের নাম এলেই এক বিশাল মহাসাগরের ইতিহাস, একটি বটবৃক্ষের বিশালতার কথা এসে যায়, কোথা থেকে যে শুরু করা যায়, আর কোন কোন দিকগুলো যে বর্ণনা জরুরী এ নিয়ে লেখককে দিকভ্রান্ত হতে হয় বৈকি। এক অদমিত কৌতূহলও এ গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আবুল হোসেনকে তাঁর সম্পর্কে লেখায় আগ্রহী করে তোলে। তারপরই তিনি বিভিন্ন সংহিতা থেকে অধ্যায়ন করে অবশেষে এই ‘বিদ্যাসাগর’ বই পাঠকদের জন্য তুলে ধরেন। বিদ্যাসাগরের কঠোর তেজোদীপ্ত মনোভাব ও যুক্তির কারণেই সে সময়ের গোঁড়া হিন্দুদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও পরে বিধবা বিয়েতে গোঁড়া হিন্দুরা নমনীয় হয়ে আসে। কারণ, সে সময়ে অধিকাংশ মেয়েদের বিয়ে হতো ১২ বছর বয়সে। স্বামী হতো হয়ত ৪০ বছরের। কলেরা, বসন্ত বা অন্য কোন মহামারীতে স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবাদের সমাজ থেকে আলাদা করে রাখা হতো। এতে তাদের অন্নকষ্ট বস্ত্রকষ্টের দুর্ভোগ হতো। বিদ্যাসাগর ছোট ও কমবয়সী মেয়েদের রক্ষার জন্য এগিয়ে এলেন। তিনি বিধবা বিয়ের সমর্থনে কথা বললেন। গ্রামের হিন্দু প-িতরা বাল্যবিয়ের কথা শুনে ছি-ছা করতে শুরু করলেন। একদিন সকালবেলা উঠে বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে ‘সদর দরজা খুলে এক প্রবীণ মানুষ দেখলেন সামনে ডাঁই করে রাখা কাঁটাগাছ। আর একটু হলেই তার ওপর হুমরি খেয়ে পড়ে রক্তারক্তি হতে পারত। সঙ্গে স্ত্রী। আহত হতে পারতেন তিনিও। সময়মতো চোখে পড়ে গিয়েছিল বলে রক্ষে। ফের পরের দিন। এবার দরজার সামনে ডাঁই করা এক গাদা জীবজন্তুর লাশ। দেখলেন স্ত্রী। তবু তার ভয়ডর তো নেই-ই, ভ্রুক্ষেপও নেই। ইদানীং এসব যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। ছেলে বিধবাদের বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। গাঁয়ের প-িতসমাজ ছা ছা করছেন। যুক্তির যুদ্ধে তারা হেরেছেন বটে, কিন্তু ঘুরপথে নাকাল করতে ছাড়ছেন না। তাই দিনের পর দিন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সমাজ সংস্কারক ছেলের বাবা-মা।’ (পৃ-১০২)। কিন্তু এরপরও বিদ্যাসাগর থেমে থাকেননি আর তাঁর ¯েœহময়ী মা ভগবতী প্রতিবারই ছেলেকে সাহস যুগিয়েছেন, ‘একবার যখন কাজ শুরু করেছ, সমাজের কর্তাদের ভয়ে পিছিয়ে এসো না, উপায় একটা বেরোবেই।’ এভাবে কঠিন প্রতিপক্ষের বিরোধিতার মুখে ঈশ^রচন্দ্রকে জীবনের প্রতিটি কাজে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। আজকের বর্তমান তৃতীয় জেনারেশন বা চতুর্থ জেনারেশন ভাবতেই পারবে না অতীত দিনের ‘বাঙ্গালা’ সমাজ কতখানি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল আর তা সংস্কারমুক্ত করতে এক একজন শিক্ষিত সংস্কারককে কতখানি সাহসী হতে হয়েছিল, কত বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। ঈশ^রচন্দ্র সে সময়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালী জাতিকে শুধু সংস্কারমুক্ত করার কাজেই এগিয়ে আসেননি, তিনি বাংলা ভাষাকে আরও আধুনিক, যুক্তবর্ণময় এবং শিশুদের জন্য পাঠোপযোগী করে রচনা করেছিলেন এবং তা মুদ্রণও করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকেই এই বইয়ের বিক্রির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৫ হাজার কপি। তিনিই নারী শিক্ষাকে আলোর মুখে নিয়ে আসার পথ রচনা করেন। তিনিই প্রথম প্রাইভেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজে গোড়া ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি ১৮৬৪ সালে ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন। এ সময় কবি মাইকেল হিন্দু ধর্ম হতে খ্রীস্টান ধর্মে যাওয়ায় পরিবারের সবাই ও অন্যরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। তিনি সে সময়ের বৃহত্তর বাংলায় অসংখ্য অবৈতনিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে তিনি খুব জেদি ছিলেন। নীতির প্রশ্নে কারও সঙ্গে আপোস করেননি। এ নিয়ে বেশ কিছু রসাত্মক দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছেন লেখক তাঁর এ অনিন্দসুন্দর বইতে। আজকের যে আধুনিক বাংলা ভাষা তার গোড়াপত্তন তিনিই করেছিলেন। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বাংলা গদ্যের প্রথম জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমরা বর্তমান প্রজন্ম সামনে এগোচ্ছি না কী পিছে চলে যাচ্ছি, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে প্রকৃত বাংলাকে ও বাঙালী জাতিকে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়ে গৌরবদীপ্ত পথে হাঁটতে যিনি শিখিয়েছিলেন, তিনিই ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার ঋণ কখনও শোধ হয় না। আর এমন মহানুভব ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লেখার প্রয়াস লেখকের অসীম এক ধৈর্য ও ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর। তাঁর এ কাজটি সত্যিই প্রশংসার দাবি করে। বইটি নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা করা জরুরী ছিল, কিন্তু তা স্থানাভাবে উল্লেখ করা গেল না। তবু এটি সত্য যে সৈয়দ আবুল হোসেনের বইটি পড়লে কেবলই শেখা যায়, কেবলই জানা যায়, আরও জানার আগ্রহ বাড়ে।
×