ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জোবায়ের মিলন

সাহিত্যের নবান্ন

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ২২ নভেম্বর ২০১৯

সাহিত্যের নবান্ন

ষড়ঋতুর এই দেশে হেমন্ত আসে শরত ঋতুর পরে আর শীত ঋতুর আগে। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তের ব্যাপ্তি। যদিও জরাগ্রস্ত শীতের আমেজ শুরু হয় হেমন্তের শুরুতই তথাপি এই হেমন্তে প্রকৃতি নিজ অঙ্গে সাজ নেয় অপরূপ। ভাদ্র-আশ্বিনের রোদ-তাপের পর ঈষৎ ঠাণ্ডার আবহ লোকমনে স্বস্তির পরশ বুলায়। প্রকৃতি এই শীতের প্রবাহে কিঞ্চিত মলিন হতে শুরু করলেও হেমন্তের নতুন ধানের আশা ও গন্ধ কৃষি প্রধান এই বাংলায় এখনও হাসির রেখা ফুটায়। জনমনে অনন্য আনন্দ ভাসে। কৃষাণীরা ব্যস্ত থাকেন ধান নিয়ে নানান কর্মকা-ে আর কৃষক শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেন আঙ্গিনার কোণে বসে। বাংলার ঋতু স্বাদ বাঙালী বলতেই জানেন। এ কেবল হেমন্ত নয়, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরত-হেমন্ত-শীত-বসন্ত সব ঋতুর রয়েছে নিজস্ব হাল-চাল; আচার-আচরণ; স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। এক এক ঋতু এক কারণে, রূপে, গন্ধে বিচিত্র অঙ্গ-রঙে রাঙ্গিয়ে তোলে বাংলার জনপদ। ভরিয়ে তোলে বাঙালীয়ান মনের মন্দির। হেমন্ত ঋতু ধানের ঋতু। আমন-আউসের ঋতু। মরা কার্তিক পার হয়ে অগ্রহায়ণ এলেই কৃষকের মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে। খেয়ে-না-খেয়ে পরিশ্রান্ত সময় কাটান আপামর গ্রাম-বাংলার কৃষিজীবী সমাজ। ধান, মাঠ ছেড়ে উঠানে এলে কর্মব্যস্ততার আরেক পর্ব শুরু হয়। উঠান-ধান উঠে যায় উনানে। সিদ্ধ ধানের গন্ধে মৌ-মৌ করে ঘর থেকে ঘর, বাড়ি থেকে বড়ি, গ্রাম থেকে গ্রাম। বলে রাখা ভাল; বাংলার কৃষিনির্ভশীলতা পূর্বের চেয়ে কমে আসলেও বাঙালী মনন থেকে উবে যায়নি এখনও। কৃষি এখনও বাংলার প্রাাণ। কৃষিকে ধরে বাঁচে বাঙালী। বাঙালী ধানের গন্ধ নাকে নিয়ে উনুন থেকে ধান গোলায় ভরে। ধান ভাঙ্গার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে তালে মুখর হয় বাড়ির আঙ্গিনা। ঢেঁকির চল উঠে গেলেও যন্ত্রচালিত ভাঙ্গন মেশিন ঢুকে গেছে ঢেঁকির কাজে। এতে সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে কৃষাণীর। কৃষাণীও যুগের সঙ্গে হয়েছে অনেকটা আধুনিক। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলাতে যেয়ে গ্রাম্য আবহের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে; আবার অনেক কিছুই সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা নিংড়ানোর শেষ বিন্দু হিসেবে এখনও কিছুটা রয়ে গেছে। তার মধ্যে হেমন্তের ‘নবান্ন উৎসব’। আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব ‘নবান্ন উৎসব’ উৎসব। নবান্ন উৎসবে পুরনো রীতি অনুসারে- নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করাই প্রচলিত। নতুন ধানের, নতুন অন্নের গ্রহণ ঘিরে ঘরোয়া আনন্দ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ঘর থেকে উঠানে, উঠান থেকে বাহিরে, বাহির থেকে প্রবেশ করে অভ্যাসে ও উৎসবে। সে উৎসব আর গ্রাম বাংলায় গেঁথে থাকে না। সারাবাংলায় ছড়িয়ে যায়। হেমন্ত এলেই বাঙালী মাতে নবান্ন উৎসবে। এখন থেকে মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের বাংলার ইতিহাস দেখলে দেখা যায় পহেলা বৈশাখের পর পরই হেমন্তের নবান্ন উৎসব নিয়ে বাংলায় ছিল রব-রব অবস্থা। ধর্মীয় দুটি ঈদ বাদে বাংলার প্রাণের নন্দ ও নন্দনই ছিল নবান্ন। নবান্নে বাঙালী মন নেচে ওঠে অনন্য এক আনন্দে। ঘরে ঘরে-পরে পরে বন্ধনের আতিথেয়তায় অনিন্দ্য এক আনন্দ ভেসে বেড়াত নিঃসঙ্কোচে। হেমন্তের এই নবান্ন উৎসব মাঠ, ঘাট, নদী, বন্দর পেরিয়ে ঢুকে পড়ে নিত্য- নৈমিত্তিকতায়। এমনই এর প্রভাব পড়তে থাকে যে, নবান্ন উঠে আসে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, নাট্যকার, উপন্যাস তথা শিল্পের মাধ্যমগুলোতে। নবান্নের ধান, গান, কথা, কবিতা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, স্বভাব-চরিত্র, ব্যাস-বৈশিষ্ট্য উপমা কিংবা উতপ্রেক্ষা অথবা প্রতীকী হয়ে ব্যবহৃত হতে থাকে সাহিত্যে। বাংলা ও বাঙালীর এই নবান্ন উৎসব বা নবান্ন নিয়ে কম রচিত হয়নি কবিতা, কম রচিত হয়নি ছড়া, কম রচিত হয়নি ধাঁধা, কম রচিত হয়নি প্রবাদ; লোকসঙ্গীত বা গীতিকা। লোককাহিনীতেও নবান্ন নিয়ে পাওয়া যায় হাজার হাজার কাহিনী। এই অল্প সময় আগেও হেমন্তে চোখে পড়ত নদীতে নায়ের সারি, নাইয়্যরীর যাত্রা। কনেকে আসতে দেখা যেত বাপের বাড়ি- এই কার্তিকে, অগ্রহায়ণে- নবান্নকে কেন্দ্র করে। এ বাড়ির জামাই আসত তার বাড়ির লোকজন নিয়ে আবার ও-বাড়ির জামাই যেত তার বাড়ির স্বজনপরিজন নিয়ে। রঙ্গিন মাটির হাঁড়ির শোভা আর মিষ্টি-ম-া, পিঠা-পায়েসের সুভাস ঘুরে বেড়াত পথে প্রান্তে সবখানে। উঠানে উঠানে নবান্ন নিয়ে মুখে মুখে গীত বেঁধে শোনানো হতো রং-ঢং করে। এখনও কি হয়না! হয়। অনেক রীতি পাল্টে গেলেও উৎসব বদলায়নি। আনন্দ বদলায়নি। আয়োজন বদলায়নি। লোককাহিনীতে যেমন রয়েছে নবান্ন নিয়ে বিস্তর গল্প, তেমনি লোকসঙ্গীতেও নবান্ন উঠে এসেছে। গীতিকবি তুলে এনেছেন তার গীতে নবান্নের স্বরূপ; খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গীতকাব্যে বর্ণনা করেছেন হেমন্তের ধানের, ধানের নবান্নের, প্রকৃতির অরূপ ব্যঞ্জনার; তিনি লিখেছেন- ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে-মলিন হেরি কুয়াশাতে/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।/ আপন দানের আড়ালেতে-রইলে কেন আসন পেতে/আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা।।’ রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গীতে দেখা যায় অগ্রহায়ণের রাতে গ্রাম্য ভেলায় সন্ধায় যে পিঠা-পুলির আসর বসে, ঘরে ঘরে যে ফিরনি-পায়েসের জোয়ার বয়ে যায়, নতুন ধানের যে হরেক আয়োজন তার ইঙ্গিত রয়েছে প্রতীকী ভাষায়- ‘এল যে শীতের বেলা বরষ পরে/ এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে/ করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ ভরা/ দেখিতে দেখিতে দিন আধার করে/ বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা/ আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা-/আসন আপন হাতে-পেতে রেখো আঙ্গিনাতে/ যে সাথি আসিবে রাতে তাহারি তরে।’ সাথির জন্য এই যে আসন পেতে রাখা, এত অতিথির কথা। নবান্ন দিনে সন্ধ্যার পর এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে, পাড়াপ্রতিবেশীর আগমন, স্বজনদের আগমনের উপলক্ষের কথা, আতিথেয়তার কথা। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় লোকগীতির আদি কবিয়ালদের গীতকবিতায়ও নবান্ন নিয়ে প্রচুর গীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতের মতো সাহিত্যের লোকনাট্যেও উদ্ধৃতি রয়েছে নবান্নের, নবান্নের আবহমান সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে নাট্যসাহিত্য। ভারতীয় উপমহাদেশে, বাংলা ভাষাভাষীর নাট্যসাহিত্যে নবান্ন নিয়ে অনেক নাট্যালাপের মধ্যে অমর হয়ে আছে নাট্যসাহিত্যিক ‘বিজন ভট্টাচার্য’ রচিত নাটক ‘নবান্ন’। নবান্নের মূল অনুষঙ্গ ধান, ধানকে ঘিরে তৎসময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ১৯৪০-৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে শুররু হয়েছিল ঘন ঘন পরিবর্তন। সে পরিবর্তনের কালো অধ্যায় থাবা বসাচ্ছিল সমাজ ব্যবস্থায় তথা বাংলার কৃষিজীবী জীবনে। তার ফলে ধান মেশানো জীবনে নেমে এসেছিল নিদারুণ দুর্যোগ। ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় দেখা দিল এক ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। লাখ লাখ লোকের মৃত্যু হলো। মুখিয়ে উঠল চারদিকে সামাজিক অবয়ব। ১৯৪৩ ও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার অনেক অঞ্চলে অজন্মার কারণে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের দেখায় স্থানীয় উৎপাদন ঘাটতি অপেক্ষা ব্রিটিশ প্রশাসনের দুর্বল বণ্টন-ব্যবস্থা এবং ধানসহ অব্যাহত শস্য-রফতানি অধিকতর হওয়ায় দুর্দশার অবস্থা ও দর বিশ্বযুদ্ধপূর্ব স্তরের দশগুণ উপরে পৌঁছায়। এই দরবৃদ্ধির প্রথম বলি হয় গ্রামের গরিব কৃষকসহ সাধারণ মানুষেরা। প্রকৃতির বিপর্যয় আর মানুষের সৃষ্টি করা সঙ্কটের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে মানবতা। এই মন্বন্তরে প্রাণ হারায় প্রায় পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ। তারই প্রেক্ষাপট আর ধান ঘেঁষা জীবন অববাহিকার মূল-মন্ত্র নিয়ে রচিত হয় নাটক ‘নবান্ন’। নবান্নের পট সম্পর্কে নাট্যসাহিত্যিক নিজেই বলেছেন- একদিন ফেরার পথে কানে এল, পার্কের রেলিঙের ধারে বলে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে; নবান্নের গল্প, পূজা-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কী হচ্ছে? তার অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই এই নাট্যরূপ উঠে এসেছিল।’ নাট্যসাহিত্যিক বিজন ভট্টাচার্য তার এ নাটকের ভেতর তৎকালীন হেমন্তস্থিত ধানের নবান্নের প্রেক্ষাপটকে এমনভাবে তুলে ধরলেন যা কিনা সর্বকালের কৃষি সংগ্রামী চেতনার মূলে মানুষের হৃদয়ের সুকোমল পর্দায় নাড়া দিয়ে যায়। নবান্ন ছাড়াও লোকনাট্যসাহিত্যের ‘জবানবন্দী, অবরোধ, মরাচাঁদ, কলঙ্ক, গর্ভবতী জননী, স্বর্ণকুম্ব’এ পরিলক্ষিত হয় এক ভিন্নধর্মী রূপ, চেতনা ও জীবনদর্শন। লোক সংস্কৃতির কোন অঙ্গ যখন কোন জনপদের কাণায় কাণায় আলিঙ্গন করে তখন তার আভাস অনিবার্যভাবে লাগে সাহিত্যে। সাহিত্য লোকসংস্কৃতির এক পর্ব। সাহিত্যের পর্ব কাব্যসাহিত্য। কাব্যসাহিত্যেও নবান্ন-রূপ অঙ্কিত হয়েছে অমিত এক রূপমাধুর্যে। সম্ভবত কবিতায়ই নবান্ন আঁকা আছে সব চেয়ে বিস্তৃতভাবে, বিশদভাবে। নবান্ন নিয়ে বলতে যেয়ে কবি ‘যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত’ তার নবান্ন কবিতায় বলেছেন- এসেছ বন্ধু?/ তোমার কথাই জাগছিল ভাই প্রাণে-/ কাল রাতে মোর মই পড়ে গেছে ক্ষেতভরা পাকা ধানে।/ ধানের ঘ্রাণে ভরা অঘ্রাণে শুভ নবান্ন আজ/ পাড়ায় পাড়ায় উঠে উৎসব, বন্ধ মাঠের কাজ/ লেপিয়া আঙ্গিনা দ্যায় আল্পনা ভরা মরাই এর পাশে/ লক্ষ্মী বোধ হয় বাণিজ্য ত্যাজি এবার নিবসে চাষে।/ এমন বছরে রাতারতি মোর পাকা ধনে পড়ে মই/ দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস্ দিয়ে বসো, সে দুখের কথা কই... ’ কার্তিকে, অগ্রহায়ণে সব সময় যে নবান্নের ধান ঘরে ওঠে, নবান্ন উৎসবের প্রধান ধানে সব ঘরে আনন্দ বয়ে যায় তাতে কখনও কখানও প্রকৃতি বাদসাধে। প্রকৃতিক দুর্যোগে কোন কোন সময় নাশ হয়ে যায় মাঠের ফসল, দুর্ভাগা ভাগ্য ভর করে কৃষকের কপালে। কখন ঘরে নেমে আসে ভঙ্গ আশা। হতাশা গ্রাস করে কৃষাণ-কৃষাণীর মন। সে মনের চিত্রই কবি এঁকেছেন তার কবিতায়। গ্রাম জনপদের কবি ‘জসীম উদ্দিন’ আবার হেমন্তের নবান্নকে দেখছেন অন্য আরেক চোখে। তিনি তার ‘ধান খেত’ কবিতায় বলছেন নবান্নের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি বা নবান্নকে ঘিরে লোকরীতির কথা- ‘পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত/ সবুজে হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের খেত।/ ছড়ায় ছড়ায়ে জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,/ ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলো শুয়েছে মাঠের পরে।/ কৃষাণ করেন বিয়ে হবে, তার হলদি-কোটার শাড়ি,/ হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা নাড়ি।/ কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষয়,/ ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাতে সাঁজের নায় ... (অংশবিশেষ)। কবিতাটির পুরু পাঠে পাওয়া যায় হেমন্ত কালীন ঋতুবৈচিত্র্য আর নবান্নের আস্ত এক বর্ণনা। অন্যদিকে চোখ রাখলে আমরা আবার দেখতে পাই কবি জীবনানন্দ দাশ বলছেন নবান্ন কালে ধান ঘরে উঠে গেলে, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ঘর ভর্তি হলে, নতুন ধানের প্রাপ্তি-সুখ পূর্ণ হলে তার আড়ালে মাঠে পড়ে থাকে যে ধানের গাছের অবশিষ্টাংশ, আনন্দের আরেক পিঠে যে উচ্ছিষ্টের দুঃখ সেও তো নবান্নের অংশবিশেষ, সেও তো এর বাহিরে নয়! কবি ‘ধান কাটা হয়ে গেছে’ কবিতায় কী লিখছেন- ‘ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন- ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়/ পাতা কুটো ভাঙ্গা ডিম-সাপের খোলস নীড় শীত।/ এই সব উৎরায়ে ঐখানে মাঠের ভিতর/ ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক- কেমন নিবিড়।/ ঐখানে একজন শুয়ে আছে দিনরাত দেখা হতো কত-কত দিন,/ হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;/ শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং/ আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স¦াদ।’ কালের বিবর্তনে যে নবান্নের উৎসবে ভাটি পড়েছে। রীতি-নীতিতে যে অভাব দেখা দিয়েছে, কৃষি প্রায় উঠে গিয়ে যে বাণিজ্যিকিকরণ শুরু হয়েছে, বৈদেশ-বিদেশ যাত্রায় যে কৃষির মেরুদ- ভেঙ্গে চুড়মার সে কথাও কিন্তু লোকসাহিত্যে না এসে পারেনি। সেই অতীত, সেই মায়া-মমতা, সেই বন্ধন, সেই বাড়ি বাড়ি উৎসব কোথায় এখন? কোথায় এখন নবান্ন? লোক দেখানো উৎসব আছে, মেকি-ফাঁকি আছে; আছে কেবল ঐতিহ্য ধরে রাখার ছায়াকপি। সে বেদনা তো সাহিত্যিককে কাঁদাবেই। কবি মোহন রায়হান ‘নবান্নের গান’ কবিতায় ব্যক্ত করছেন সে কান্না- ‘... নাই গোলাগর, গোয়াইল, ঢেঁকিঘর, সাইজনাতলা, আইশাল/ কাতি-আগুনের পাহা দানগন্দ আমার পাতালে নাই নবান্নের আসি/ পিটা-পুলি আর এ জনমে খাওয়া ওবো কিনা কেডো জানে/ পাড়া-পড়শির মধুর জ্যাফত আইল কোনে হায়! পাড়াভাঙ্গা-বানবাসা কিষকের গরে ফিরা আইসপ কি আর নবান্ন গান?’ হেমন্তের মূল সুর ধান। আর ধানের চেরা চালের রান্না নবান্ন নিয়ে বন্ধনা হয়নি এমন একটি শাখাও নেই লোকসাহিত্যে। লোকসাহিত্যের ছড়াসাহিত্যেও নবান্ন এসেছে নিজের রূপে। সে রূপ হোক আদি-রূপ, কিংবা আধুনিক রূপ। হোক নবান্নের উজান কিংবা ভাটি চিত্র। এক এক সাহিত্যিক এক এক সময় এক এক কল্পনায়, ভাবনায়, চোখে, দৃষ্টিতে দেখেছেন নবান্ন আবার একই সাহিত্যিক নবান্নকে দেখেছেন এক এক সময় এক এক দৃশ্যে। যে যখনই যেভাবেই দেখেছেন সেভাবেই শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাষাল শৈলিতে নবান্নকে তুলেছেন সাহিত্যের মর্মমায়ায়। বাংলার চিরদিনের একটি প্রেক্ষাপটকে ধরে রাখতে চেয়েছেন বাক্যের গড়নে, গঠনে। বিদ্রোহী কবি খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও চোখ আর অনুভূতি ফাঁকি দিতে পারেনি নবান্নের আয়োজন, উৎসব, চারদিকের ব্যবহৃত চিত্র। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়ে এলো কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ/ ‘গিন্নি-পাগল’ চালের ফিরনি; তশতরী ভরে নবীনা গিন্নি/ হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত/ শিরনি রাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!/ মিয়া ও বিবিতে বড়ো ভাব আজি খামারে ধরে না ধান।/ বিছানা করিতে ছোটো বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান। ...’ (অঘ্রাণের সওগাত)। ঘরে ধান উঠার পর, সে ধানে ফিরনি, শিরনি রান্না হলে বধূ তার স্বামীর পাতে দিয়ে যে আনন্দ পান, গোলায় ধার উঠার আনন্দে যে কৃষাণীর স্বরে গান আসে অর্থাৎ সারা আবহে, ভাবে, ভঙ্গিতে যে বিচিত্র খুশি খেলা করে তা কবির চোখ কে ফাঁকি দিতে পারেনি। এ শুধু কবির চোখের দেখা একটা চিত্র না। এমন হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দেখা যায় নবান্নের কালে। হেমন্তের কালে। ধানের মৌসুমে। তার সাক্ষী আমাদের লোকসাহিত্য। ছড়াকার জুলফিকার শাহাদাত বলছেন- ‘নতুন ধারেন গন্ধ আসে নাকে/ চিতই পিঠা হাত বাড়িয়ে ডাকে।/ খেজুর রসে ভাঁপাও খাবো ফের/ নবান্ন আজ কী যে আনন্দের।/ নতুন করে সাজবে যেন সব/ পাখ-পাখালির সধুর কলরব।/ শিশির ফোঁটাও ঝড়ছে এমন ঢের/ নবান্ন আজ কী যে আনন্দের।...’ (নবান্ন)। কিন্তু ছড়াসাহিত্যিক বেণীমাধব সরকার কী বলছেন? তিনি বলছেন- ‘...গান গেয়ে ধান কাছে কিষান, বাঁধে আঁটি আঁটি/ মধুর সুরে উপচে ওঠে গাঁয়ের সুরো মাঠই/ পাড়ায় পাড়ায় খুশির ছটা নবান্ন উৎসব/ বাড়ি বাড়ি ঢেঁকির পাড়ে মধুর কলরব।...’ (হেমন্ত)। ধান ঘর আসলে কৃষকের ঘরে স্বচ্ছতা আসবে সে আশায় যতই কষ্ট হোক কৃষকের কাছে সে কষ্টকে কষ্ট মনে হয়না। কষ্টকে সে আনন্দে রূপ দিয়ে গান গাইতে গাইতে ধান কাটে। ধান দিয়ে চাল হবে, সে চালের পিঠা-পুলিতে খুশির বন্যা বইবে, কৃষাণীর পায়ে পায়ে দোল খেলবে ঢেঁকির পাড়, পাড়ে বের হয়ে আসবে চালের গরম চিড়া, উঠানে বসে ছেলে-মেয়েরা খাইবে প্রাণ ভরে সে দৃশ্য কৃষক চোখে ভাসিয়ে কতনা গানের কলি ধরে গাইতে থাকেন আপন মনে। এত শুধু এক কৃষক নয়, সারা গাঁয়ে, সারা বাংলায় নবান্নের উৎসবে এমনই মধুর চিত্র উড়ে বেড়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়। গদ্যেসাহিত্যেও বাদ পড়েনি নবান্নের রূপবৈচিত্র্য। নবান্নের নানান দিক উঠে এসেছে গদ্যেও। প্রবন্ধেও দেখা মেলে তার। শ্রী দীনেন্দ্রকামার রায়ের ‘নবান্ন’, আশরাফ সিদ্দিকীর ‘আমাদের আবহমান নবান্ন উৎসব’, শামসুজ্জামান খানের ‘নবান্ন উৎসব’, বরুণকুমার চক্রবর্তীর ‘পার্বণে উপেক্ষিতার আর এক নাম নবান্ন’, সোমেন চৌধুরীর ‘নবান্ন: একটি লোক উৎসব’, প্রদ্যোত কুমার মাইতির ‘নবান্ন: বাঙালীর জাতীয় উৎসব’, তিতাশ চৌধুরীর ‘নবান্ন উৎসবে গ্রামবাংলা’, আমিনুর রহমান সুলতানের ‘ময়মনসিংহের নবান্ন উৎসব’, বিজন কুমার ম-লের ‘নবান্ন-এর রূপরেখা’, দীপককুমার বড় প-ার ‘নতুন ধানের নবান্ন’ সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নবান্ন ও আদিবাসী সমাজ’, শামস আলদীনের ‘গ্রামবাংলার উৎসব নবান্ন’ গদ্য-প্রবন্ধে বিন্যস্ত আছে বাংলার নবান্ন উৎসবের মুখ ও মুখোশ্রীর বহুযুগ ধরে চলে আসা লোক-উৎসবের কথা কাহিনী। কালের বদলে বদলে গেছে অনেক কিছু। বদলে যাবে আরও অনেক দেখা অদেখা। কালের গতর থেকে হারাবে একদিন গ্রাম্য নবান্নের সব আয়োজন, এ মিথ্যা নয়। তবে সাহিত্যে নবান্নের উৎসব আর কৃষ্টি-কালচার নিয়ে যে অমর সৃষ্টিগুলো রোপিত হয়েছে, যে ঝলমলে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গেঁথে রয়েছে তা বেঁচে থাকবে যুগ-যুগ ধরে। সত্যকে অস্বীকার করতে নেই যে, সভ্যতা বদল হবে, সভ্যতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বহু সংস্কৃতি চলে যাবে পেছনে, বহু সংস্কৃতি আসবে সামনে এটাই নিয়ম। কিন্তু বাংলা ও বাঙালীর নিজস্ব যে সংস্কৃতি তা যতদিন ধরে রাখা যায় ততই নিজস্বতার জন্য মঙ্গল। পৃথিবীর সব দেশের, সব মতের নিজস্বতা থাকে; নবান্নও বাংলা ও বাঙালীর একান্ত নিজেদের উৎসব, নিজেদের কালচার। যেহেতু নবান্ন ধান নির্ভর সেদিন থেকে ধান, কৃষক, মাঠ, জমিন যতদিন থাকবে নবান্নও ততদিন থাকবে বিশালাকারে বা উৎসব-পার্বণ হিসাবে। আর লোকসাহিত্যে নবান্ন স্থির হয়ে গেছে। সাহিত্য যততদিন থাকবে নবান্নের নিদর্শন পাওয়া যাবে পাঠে-পরিক্রমায়।
×