ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে ...

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২২ নভেম্বর ২০১৯

ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে ...

গত কয়েক মাস ধরে অফিসে কাজের চাপ খুব ছিল, এর মধ্যে একজন সহকর্মী ছুটিতে থাকায় আমার কাজের পাশাপাশি তার কাজও করতে হয়েছে। যে কারণে কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে মন চাইছিল কোথাও ছুট দেই। ভ্রমণসঙ্গী সানন্দাকে বলে রাখলাম তুমি তোমার মেডিক্যাল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করে রেখ। যেই বলা সেই কাজ নির্ধারিত দিনে আমরা রওনা হলাম কক্সবাজারের পথে। রাতের আঁধার পেরিয়ে সেই সক্কাল বেলা আমাদের গাড়ি পৌঁছাল কক্সবাজার শহরে। হোটেলে প্রবেশ করে ফ্রেস হয়েই বেরিয়ে পরলাম সমুদ্র দর্শনে । সমুদ্র দর্শন শেষে হোটেলে এসে পেট পূজা শেষ করে আমরা বেরিয়ে পরলাম নতুন গন্তব্য পানে। আমাদের চার চাকার পাইলট ফরহাদ আমাদের নিয়ে চলছে নতুন গন্তব্য পানে। আমরা চলছি ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের (যা ডুলা হাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক নামেও পরিচিত) দিকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপলীলা ভূমি কক্সবাজার জেলা। পাহাড়, পর্বত, ঝরনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দিয়ে ঘেরা এই জেলাটি। এই জেলার চকরিয়া উপজেলাতেই ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক অবস্থিত। এটি দেশের অন্যতম সাফারি পার্ক । বিলুপ্ত প্রায় ও বিরল প্রজাতি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বংশ বৃদ্ধিসহ মানুষের চিত্ত বিনোদন, গবেষণা ইত্যাদি পরিচালনার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন চকরিয়া উপজেলা এলাকায় স্থাপিত দেশের অন্যতম ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক’ পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। রাস্তার দুই ধারেই প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করছে। আমাদের পাইলট মহোদয় গন্তব্য স্থলের রাস্তা ঠিক চিনে না তাই গুগল ম্যাপই ভরসা। গুগল ম্যাপের দেখানো পথ নির্দেশনায় আমরা চলছি এগিয়ে। আগের থেকে পথের অবস্থা অনেক ভাল। সেই লক্কড়-ঝক্কড় সড়ক আর নেই। আমাদের দেশ যেসব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে তাই তার প্রমাণ। প্রায় এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পর মহাসড়কের হাতের ডান পাশে লেখা দেখতে পেলাম ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক। দুই পাশে দুটো হাতি আমাদের স্বাগতম জানালো। কিছুটা পথ এগিয়ে আমরা দেখতে পেলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। এর পাশেই ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক এর প্রবেশ পথ। গাড়ি থেকে নেমে আমরা টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সামনেই দেখা পেলাম ডাইনোসার, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জিরাফ এর প্রতিকৃতি। সময়টা ভরদুপুর গত রাতের যাত্রা পথের ক্লান্তি এখনও ছাড়েনি। এদিকে ভেতরে ঘুরার ম্যাপ দেখে বুঝতে পারলাম পুরোটা পার্ক হেঁটে দেখা এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে সম্ভব না। সেক্ষেত্রে সবকিছু দেখা অধরাই রয়ে যাবে। কি করা ভাবছিলাম এর মাঝেই একজন লোক এলেন পার্কের, বললেন বাস লাগবে কিনা...? পুরো পার্ক ঘুরিয়ে দেখাবে। আমি বললাম কত টাকা লাগবে বললেন পুরো বাস ভাড়া নিলে তিনশ’ টাকা লাগবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। ওই ভদ্রলোক এটাও বলল বাস ড্রাইভারকে বকশিস দিলে সেসব জায়গাই সময় নিয়ে দেখাবে। আমি বললাম অসুবিধা নেই বকশিস দিব। আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কিছু দূর বাস যাবার পরই বাসের সহকারী বাস থামিয়ে দেখতে লাগলেন। আমরা দেখা পেলাম নানা প্রজাতির কচ্ছপের। সবাই গরমে ক্লান্ত তাই ছায়ায় গিয়ে বসে আছে। এর সঙ্গেই অজগরের খাঁচা। এই খাঁচার বিপরীতেই আছে বন্যপ্রাণী হাসপাতাল। এখানে অসুস্থ পশু পাখিদের চিকিৎসা দেয়া হয়। আবার আমরা বাসে করে এগিয়ে গেলাম। মিনিট খানেক পরে দেখা পেলাম ইমু পাখির। আমাদের দেখে ইমু পাখি এগিয়ে এলো। ইমু পাখির ব্যবহারে বোঝা গেল মানুষের সঙ্গে সখ্য ইমু পাখির খুব প্রিয়। এর পাশেই দেখা পেলাম পেখম তোলা ময়ূর। সঙ্গেই আছে অসমি বানর। এদিক থেকে ওদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বানর, এর পাশে শিয়ালের খাঁচা। কালো রঙের শিয়ালটি খাঁচার এ মাথা থেকে ও মাথা শুধু ঘুরছে। যেন সুযোগ পেলেই খাঁচার থেকে পালিয়ে যাবে। এর পাশেই আছে লেজ উল্টো বানর। সে যেন সব সময় শিয়ালকে বুদ্ধি দিচ্ছে কীভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়। পাশের খাঁচায় দেখা পেলাম বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এখানে কিছু পাখি খাঁচায় বন্দী বাকি পাখিগুলো প্রাকৃতিকভাবে ছাড়া। এরপর আমরা বাসে উঠে এগিয়ে চললাম। বেশ ঘন বন। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ গাছালিতে ভরা। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত নির্জন উঁচু নিচু টিলা, প্রবহমান ছড়া, হ্রদ, বিচিত্র গর্জনের মতো সুউচ্চ ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক বৃক্ষ চিরসবুজ বনের জানা-অজানা গাছ-গাছালি, ফল-ভেষজ উদ্ভিদ, লতার অপূর্ব উদ্ভিদের সমাহার ও ঘন আচ্ছাদনে গড়ে উঠেছে সাফারি পার্ক। ছায়া ঘেরা পথ, সবুজ বনানী, জানা-অজানা গাছের সারি, পাখি আর বানরের কিচিরমিচির সবকিছু মিলিয়ে যেন এক অসাধারণ অনুভূতি। লেকের পাশে দেখা পেলাম লোনা পানির কুমির ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর সঙ্গেই সরস পাখির বাস। আমরা এগিয়ে গেলাম সম্মুখ পানে। আমাদের পথ আগলে ধরল হাতি আর তার মাহুত। কি আর করা হাতিকে বকশিস দিতেই হলো। কিছু দূর যাবার পর দেখা পেলাম দশ তলা ওয়াচ টাওয়ার। কিন্তু ওয়াচ টাওয়ার কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ করা। ওয়াচ টাওয়ার বন্ধ কেন জানতে চাইলে জানানো হলো যে ওয়াচ টাওয়ারের রেলিং ভেঙ্গে গেছে তাই এখন এটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এর পরেই দেখা পেলাম লেকের জলে জলহস্তির, ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের গাইড সাহেব পাশ থেকে কিছু লতাপাতা ছিঁড়ে জলহস্তিগুলোকে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে জলহস্তিগুলো আমাদের দিকে আসতে লাগল। গাইড সাহেব জলহস্তির দিকে খাবার ছুড়ে দিল। খাবার পেয়ে জলহস্তিগুলো খুব উচ্ছ্বাসিত মনে হলো। এরপরে আমরা গেলাম বাঘের খাঁচার দিকে। দেখা পেলাম বাঘের খাঁচার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীকে। তিনি আমাদের বাঘের খাঁচার দিকে নিয়ে গেলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি উনি ইশারা দিতেই বাঘ মহাশয় ওনার একদম কাছে চলে এলো। আমার ও ওনার সঙ্গে বাঘের মাথা হাতিয়ে দিলাম। এর সঙ্গেই আছে সিংহ মামার খাঁচা। সেখানে গিয়ে ভদ্রলোকটি রাসেল কোথায় বলতেই সিংহ মামা দৌড় দিয়ে কাছে চলে এলো। আবার উনি বললেন রাসেল এবার গর্জন করে দেখাও তো ... বেশ কয়েকবার বলার পর ঠিক ঠিকই সিংহ মামা গর্জন করে উঠল। যাই হোক সিংহ মামার কর্মকাণ্ড দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। আরও দেখা পেলাম জেব্রা , গয়াল , সম্বরহরিণ, চিত্রাহরিণ, প্যারাহরিণ। দেখতে দেখতে কীভাবে যে তিন ঘণ্টা পার করে দিলাম বুঝতেই পারলাম না। এদিকে আমাদের বিদায় বেলা চলে এলো আমরা ফিরে চললাম কক্সবাজার শহর পানে। কীভাবে যাবেন ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী সৌদিয়া, এস আলম, গ্রিনলাইন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, মডার্ন লাইন প্রভৃতি বাসে সরাসরি ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের সামনে নামতে পারবেন। শ্রেণীভেদে বাসগুলোর প্রতি সিটের ভাড়া জনপ্রতি ৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঢাকা থেকে ট্রেনে ভ্রমণ করতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেল স্টেশন হতে সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা-নিশীথা, মহানগর প্রভাতী/গোধূলি, চট্টগ্রাম মেলে যাত্রা করতে পারেন। এরপর চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ এলাকা অথবা দামপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে এস আলম, হানিফ, ইউনিক ইত্যাদি বিভিন্ন ধরন ও মানের বাসে ২৮০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা ভাড়ায় ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে আসতে পারবেন। এ ছাড়া কক্সবাজার এসে সিএনজি, মাইক্রো কিংবা লোকাল বাসে চড়ে অনায়াসেই ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে যেতে পারবেন।
×