ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ী শহর লোনাভালা

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২২ নভেম্বর ২০১৯

পাহাড়ী শহর লোনাভালা

মুম্বই ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য মুম্বই প্রাচীন এবং আধুনিক সময়ের এক জননন্দিত শহর। বলিউড হিসেবে খ্যাত এই চলচ্চিত্রসমৃদ্ধ অঞ্চলটি সপ্তদশ শতাব্দীতে একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক শহর হিসেবেও তার বহুল পরিচিতিকে তুলে ধরে। মুম্বাই মানেই ভারতের সিনেমা জগতের এক অবিস্মরণীয় আধুনিক শিল্পনগরী, অমিতাভ বচ্চন, আমীর খান, সালমান খান এবং শাহরুখ খানের সুরম্য ভবনের এক অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্র নগরী। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত মহারাষ্ট্র রাজ্যের মূল আকর্ষণই এই মুম্বই। কন্যা নমিকে নিয়ে এই শিল্পনগরী দেখার অদম্য বাসনা থেকে বাংলাদেশের রিজেন্ট বিমান যাত্রায় ১৮ অক্টোবর বেলা বারোটায় কলকাতার সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলাম। ৩ ঘণ্টা পর মুম্বাইয়ের উদ্দেশে ভারতের ইন্ডিকো বিমানে যাত্রা শুরু করি। যাত্রাপথে ঘটে যায় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। নমিকে খুঁজতে গিয়ে চারদিকে যখন তাকাচ্ছি ঠিক সে সময় এক পঞ্চশোর্ধ ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েকে খুঁজছেন বুঝি? তাকিয়ে দেখলাম অতি সাধারণ বেশে এক বুদ্ধিদীপ্ত চাহনির অসাধারণত্ব। উত্তরে বললাম হ্যাঁ, সে কই? ভরাট কণ্ঠে বললেন-ওই যে, আপনার মেয়ে। ইতোমধ্যে নমিও আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে মা উনাকে চিনতে পেরেছ? উনি কিন্তু সেই বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। এতক্ষণ আমি উনার সঙ্গে কথা বলে অটোগ্রাফ নিচ্ছিলাম। আর তুমি চিনতেই পারলে না? মেয়েকে একটু ভর্ৎসনাও করলাম। কেন আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলা না। মুম্বাই দিল্লী, আগ্রা, আজমীর, জয়পুর ভ্রমণের শুরুতে যে ব্যক্তিত্বকে দেখলাম তাতেই মনে হলো শুভ সফরের এক আকর্ষণীয় যোগ, সেখানে দেশ দর্শনের অর্ধেক আনন্দ আর আবেগে হৃদয়পূর্ণ হলো। চোখে ভাসতে লাগল এক সময়ের আলোড়নকারী সিনেমা অন্তর্জলি যাত্রা কিংবা পদ্মা নদীর মাঝি। ততক্ষণে আমার সামনেই এই বিখ্যাত মানুষটি বিমানে উঠলেন। তবে ধারে কাছে তার বসার জায়গাটি ছিল না। ফলে আলাপের সুযোগই হয়নি। সে অপূর্ণতায় মন সত্যিই ভারাক্রান্ত। ৩ ঘণ্টায় আমরা অবতরণ করলাম ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে মুম্বাইয়ের পশ্চিমে মালাদ অঞ্চলের দিকে রওনা দিলাম। রাত দশটায় আমাদের বুকিং দেয়া রিসোর্ট রিট্রিটে পৌঁছালাম। পরের দিন সকাল থেকেই শুরু হলো আমাদের দর্শনীয় স্থান দেখার যাত্রার সূচনা। ভারতের বাণিজ্য এবং বিনোদনের পীঠস্থান এই বিখ্যাত নগরটি। শুধু তাই নয় প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতনের ভূমিটি পাহাড়, সমুদ্র এবং সুদৃশ্য সবুজঘেরা নৈসর্গিক রূপ সম্ভারে পরিবেষ্টিত। এই সমুদ্র নগরটি ভ্রমণকারীদের চিত্ত বিমোহিত করারও এক অভাবনীয় তীর্থ ভূমি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই প্রাচীন শহরটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করলে তা ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ফলে ব্যবসা বাণিজ্যেও এর অবিস্মরণীয় যাত্রা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের এক অনবদ্য সংযোগ সাধনায় এই নগরীর মূল্যমান বৃদ্ধিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখে। আমরা মূলত একটি গাড়ি ভাড়া করে সারাদিনের জন্য মুম্বাই শহর দেখার উদ্দেশে রওনা দিই। উদ্দেশ্য লোনাভালা, খা-ালা দুই পাশাপাশি পাহাড়ের অনিন্দ্য সুন্দর শোভা উপভোগ করা। মুম্বাই থেকে প্রায়ই ৮০ কিলোমিটার দূরে এই পাহাড়ী সৌন্দর্য দেখার অদম্য উৎসাহ নিয়ে যখন মুম্বাই শহর অতিক্রম করছিলাম তখন এই আকর্ষণীয় স্থানটির তীব্র যানজটই শুধু নয় চারপাশে বিস্তীর্ণ এক বস্তি এলাকা আমাদের হতচকিত করে। মুখেশ আমবানির মতো শিল্পপতির জায়গাটিতে চারপাশের এমন দারিদ্র্য এবং সড়কের দুরবস্থা সত্যিই আমাদের হতবাক করে দেয়। আবার পাশাপাশি চমৎকারভাবে সাজানো-গোছানো ব্রিটিশ নির্মিত সুরম্য ভবনগুলো। ইউরোপীয় স্থাপত্যের আদলে তৈরি করা এসব সুদৃশ্য ভবন দেখে মনে হলো ব্রিটিশরা অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে এই নগরীর ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যকে অনুধাবন করতে পেরেছিল। যার কারণে অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত প্রথম তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জায়গা করে নেয় মুম্বাই শহরে। যেতে যেতে সেটাও এক নজর দেখে নিলাম। এখানে ক্যাম্পাস তৈরিতে ব্রিটিশ স্থাপত্যের ছাপ বিদ্যমান। এবার আমরা শহর থেকে আস্তে আস্তে সুউচ্চ পাহাড়ের অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। লক্ষ্য লোনাভালা এবং খা-ালার মনোরম প্রাকৃতিক বৈভবকে একেবারে সামনে থেকে বিমুগ্ধ নয়নে অবলোকন করা। শহর থেকে মূল গন্তব্য যাওয়ার যাত্রাপথ অপেক্ষাকৃত নীরব এবং নির্জন। যানবাহনের তেমন কোন চাপই নেই। ভাল লাগছিল এমন মনোমুগ্ধকর চারপাশের নৈসর্গিক দৃশ্যকে মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করতে করতে পাহাড়ের পাদদেশকেও অতিক্রমা করার ভিন্ন মাত্রার অনুভবে। সত্যিই ভারতবর্ষ এক অনবদ্য রূপ সম্ভারের যথার্থ তীর্থক্ষেত্র। পাহাড়ঘেঁষা সবুজের সমারোহে লোনাভালায় উঠতে উঠতে যে মনোরম শৈল্পিক সুষমা আমাদের আচ্ছন্ন করে তার অনুভব শুধু দর্শনেই। কি অপরূপ মনভোলানো আকর্ষণীয় শ্যামল ঘন পাহাড়ী রাস্তা যার অনাবিল সৌন্দর্যে ভ্রমণকারীদের আনন্দ কোন মাত্রায় চলে যায় তেমন খুশির জোয়ারও দুই চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিতে। লোনাভালা নামটি এসেছে প্রাচীন সংস্কৃত লোনলি শব্দ থেকে যার অর্থ গুহার শহর। ধারে কাছেই নিদর্শন পাওয়া যায় কারলা ভাজা বেদমা ত্রয়ী বৌদ্ধ গুহার। যা প্রাচীন বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্থাপনার নিদর্শন। প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির অবারিত দানের মনোহর দৃশ্যে আমরা অভিভূত, পলকহীন। বিস্ফারিত নয়নে শুধু পাহাড়ী সৌন্দর্যকে সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে উপভোগ করার। প্রায়ই ২ হাজার ফুট উপরে ওঠার আঁকাবাঁকা রাস্তায় কোনভাবেই ভয়ের চমক ছিল না। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় উঠতে গিয়ে চারপাশ দেখে আমরা যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠি অজানা আশঙ্কায়। লোনাভালা ও খা-ালা পাহাড়ে ওঠার সময় তেমন ভয়াবহ দৃশ্য একেবারে আড়ালে আবডালে। মেয়ে বলছিল কেন ভয় পাচ্ছ না জানো মা? চারপাশে অসংখ্য সবুজবৃক্ষের আচ্ছাদনে রাস্তার দু’পাশ ঢেকে দেয়া হয়েছে। আর সে কারণে কোথায় উঠছি, কিংবা কতখানি উঠলাম বোঝারও উপায় নেই। লোনাভালার সর্বোচ্চ শিখরে উঠে মনে হলো এক কাল্পনিক জগতের মায়াঘেরা সুরম্য চূড়ায় আকাশ ছোঁয়ার একেবারে নিকটবর্তী। হাত বাড়ালেই মনে হয় পাহাড়, উপত্যকা, হৃদ, গুহা সবই যেন মুঠোয় ধরা দেবে। এই শিখরে মেঘের আনাগোনা আরও মনোহর এবং চমকপ্রদ প্রকৃতির অপরূপ শোভা। মেঘ তো নয় মনে ইচ্ছে ধূসর কালো ধোঁয়া সারা আকাশে দিগি¦ক ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি তার অপার সমারোহে যে মাধুর্য বিলিয়ে দিচ্ছে তা ভ্রমণকারীর এক অনাবিল প্রাপ্তির অবিস্মরণীয় আনন্দ যোগ। এত ওপরে উঁচু-নিচু পাহাড়ী রাস্তায় যে এত অভিনব সৌন্দর্য তার অকৃত্রিম দানে পর্যটকদের হৃদয় আবেগে আনন্দে ভরিয়ে দিচ্ছে তেমন সুদৃশ্য রূপ মাধুরী চিরস্থায়ী আনন্দের খোরাক। প্রকৃতির সাজানো-গোছানো অপরূপ পাহাড়ী ঝর্ণাও নাকি বর্ষণস্নাত সময়ের এক অনন্য শোভা। তেমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আসলেই হয়নি। শুনেছি মাত্র। আমাদের বাংলাদেশও অনেক সুন্দর। পাহাড়, সমুদ্র, নদী, সবুজ বন পরিবেষ্টিত ছোট এই দেশটিও প্রকৃতির অপরূপ দানের এক বৈচিত্র্যক লীলাভূমি। ষড়ঋতুর বহুমাত্রিক পরিবেশ ভা-ারে নিয়তই প্রবহমান এই দর্শনীয় মাতৃভূমিকেও মনে পড়ে যায় যখন অন্য কোন দেশে সেই নৈসর্গিক বৈভবের সমদৃশ্য উপভোগ করার সুবর্ণ সময়ে। লোনাভালার প্রাপ্তি, রম্যতা, শ্যামলতায় সম্পূর্ণ অবগাহন করে ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগালাম তেমন দৃশ্যও ভুলবার নয়। উপরে ওঠার সময় যে সুখ অনুভূতি মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নামতে গিয়ে অন্যমাত্রায় ভারাক্রান্ত অন্তরে বেদনার মুখোমুখি হলাম।
×