ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘূর্ণিঝড়কে জৈবঢাল হিসেবে আটকে দেয় সুন্দরবন

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২২ নভেম্বর ২০১৯

ঘূর্ণিঝড়কে জৈবঢাল হিসেবে আটকে দেয় সুন্দরবন

বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরা উপজেলায় ৯ নবেম্বর রাতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। এরপর এটি সুন্দরবনের খুলনা ও বাগেরহাট অংশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। তবে প্রবল শক্তির এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সেভাবে পড়তে পারেনি সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পাবার কারণে। ভূখন্ডে আঘাত হানার সময় এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৪০ কিলোমিটার, কিন্তু সুন্দরবনের গাছপালার কারণে সেটির প্রভাব ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের মতো অনুভূত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বনাঞ্চলের ওপর দিয়ে দুই ধরনের ধাক্কা যায়। প্রথমে ক্ষিপ্র গতির বাতাস এরপর জলোচ্ছ্বাস। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম গতি নিয়ে খুলনা আর বাগেরহাটে লোকালয়ে পৌঁছায়। বনে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ যেখানে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার ছিল, সেটা বন পার হয়ে লোকালয়ে যেতে যেতে শক্তি হারিয়ে দমকা বাতাসে রূপ নেয়। মূলত সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড় প্রবেশের পর সেটি দুর্বল হয়ে যায়। সুন্দরবন থেকে এটি ঘূর্ণিঝড় আকারে বের হতে পারেনি। ধীরে ধীরে ভোরের দিকে গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হওয়া প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ দিয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশের অংশে এসে বনের মধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। সুন্দরবনের গাছপালার মধ্যে ঝড়ের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। ফলে লোকালয়ে প্রবেশের আগেই এটি গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। এতে আবারও রক্ষা পেয়েছে উপকূলীয় জনগণ।’ অপর আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে পশ্চিমবঙ্গ এবং খুলনা হয়ে, সুন্দরবনের ওপর দিয়ে। তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে দমকা হাওয়ায় ১২০ কিলোমিটার। তখন এটা ছিল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু স্থলভাগে সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে এটা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। বাতাসের গতিবেগ কমে গিয়ে ৬০ থেকে দমকায় ৮০ কিলোমিটার হয়। সুন্দরবনের গাছপালা ঘূর্ণিঝড়কে প্রতিরোধ করায় সেটা দুর্বল হয়ে পড়ে।’ অন্যদিকে, জলোচ্ছ্বাস লোকালয়ে পৌঁছানোর আগে সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় ঢেউয়ের উচ্চতা অনেক কমে যায়। এ কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলো প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি বা ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তেমন থাকে না বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলাতেও একইভাবে এই অঞ্চলকে আগলে রেখেছিল সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী আবহাওয়া অধিদফতরের প্রেস ব্রিফিংয়েও জানানো হয়, সুন্দরবন অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় বেশিদূর এগোতে পারে না বলে চলতি বছরের অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের কোন প্রভাব বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পড়েনি। কিন্তু একই ঘূর্ণিঝড় যদি বরিশালকেন্দ্রিক হতো তাহলে বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্যোগ বয়ে আনত বলে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সুন্দরবনের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ঠেকাতে এর আগেও ঢাল হিসেবে কাজ করেছে সুন্দরবন। বিশেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার তান্ডব থেকে এই বন উপকূলকে রক্ষা করেছে। যদিও সেই দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছিল বিস্তৃত বনাঞ্চল। তবে এবার উপকূলীয় সন্তানদের (উপকূল এলাকার মানুষ, ঘরবাড়ি ও পশুপাখি) রক্ষা করলেও নিজে তেমন বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়নি সুন্দরবন। কারণ সুন্দরবনে যে সময়টায় জোয়ার হয়, সে সময়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত করেনি। যার কারণে এবার পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চাইতে খুব একটা বেশি ছিল না। অবশ্য ঘূর্ণিঝড়টি প্রবল বেগে সুন্দরবনে আছড়ে পড়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছপালা কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে প্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি তেমন একটা হয়নি। সুন্দরবনে জরিপ চালিয়ে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনের সাড়ে ৪ হাজার গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি বন বিভাগের বেশ কিছু অবকাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে বুলবুলের প্রভাবে সুন্দরবনে ১ কোটি ১৩ লাখ ২১ হাজার ৯শ’ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগে মূলত ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতটি বেশি ছিল। কিন্তু এ আঘাতে সুন্দরবনে মারাত্মক কোন ক্ষতি হয়নি। কোন প্রকার পশু-প্রাণীর ক্ষয়-ক্ষতির আলামত এখানে পাওয়া যায়নি। তবে, পশ্চিম বিভাগে ৪ হাজার ২টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১ লাখ ৭৪ হাজার ৯শ’ টাকা। আর অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, গাছ-পালার যে ক্ষতি তা সুন্দরবন নিজেই পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে। সে জন্য সুন্দরবনকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। আমরা সেভাবেই পদক্ষেপগুলো নিতে শুরু করেছি। তিনি আরও জানান, বুলবুলের আঘাতে সাতক্ষীরা রেঞ্জের পুষ্পকাঠি ফরেস্ট স্টেশনের ঘর, কদমতলার এফজি ব্যারাক ও রান্না ঘর, কাঠেশ্বর অফিসের ছোট ট্রলার এবং রান্না ঘর, কোবাদক স্টেশনের কাঠের ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে জেটি, ব্যারাক ও রান্নাঘর, চুনকুড়ি স্টেশনের সোলার প্যানেল, দোবেকি টহল ফাঁড়ির ৪০ ফুট দীর্ঘ পন্টুন, নলিয়ান রেঞ্জ অফিসে যাতায়াতের রাস্তা ও অফিস ঘিরে থাকা গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, বুলবুলের আঘাত পূর্ব সুন্দরবনে তেমন একটা ছিল না। তারপরও যাচাই-বাছাই করে পূর্ব সুন্দরবনে ৫৮৭টি গাছ-পালা ক্ষতির আলামত পাওয়া গেছে। বন্য পশু পাখির কোনও ধরনের ক্ষতির আলামত পাওয়া যায়নি। আর পূর্ব বিভাগে বন বিভাগের অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বুলবুলের আঘাতে বনের মধ্যে ৬টি আবাসিক ভবন, ১৭টি অনাবাসিক ভবন, ১০টি জেটি, ৩টি জলযান, ১৯টি অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জৈবঢাল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের প্রান্তে অনেকটা চোঙ আকৃতির উপকূলভাগ থাকার কারণে তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এখানে অভিশাপের মতো প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। তবে সুন্দরবন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে কাজ করে। সত্যি কথা বলতে কী, সুন্দরবনÑ তার সৃষ্টির পর থেকেই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় জৈবঢাল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের জানা ইতিহাসের মধ্যে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে আছড়ে পড়া ছোট-বড় প্রায় ২৫৯টি ঘূর্ণিঝড়ের আক্রমণ সুন্দরবন জৈবঢাল হিসেবে অনেকটাই আটকে দিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের নবেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডরও স্থলভাগে উঠে এসেছিল সুন্দরবন উপকূল দিয়ে। এর মধ্যে আইলায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর সিডরের শক্তি ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকাগুলোর মানুষদের জীবনে সিডর; এক দুঃসহ স্মৃতির নাম। ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। সেই সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। আহত হয়েছিল অর্ধ লাখেরও বেশি। কিন্তু আরও বহু মানুষ বেঁচে যায় সুন্দরবনের কারণে। দেশের সর্বমোট ৩০টি সিডর আক্রান্ত জেলার মধ্যে সেদিন নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চারটি জেলা। স্মরণকালের অন্যতম সেই ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংস হয়েছিল গণনাতীত বন্য ও গৃহপালিত পশুপাখি এবং গাছপালা। সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক বিনষ্ট সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ ঘরবাড়ি সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল অসংখ্য রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেতু, পুকুর ও মাছের ঘের। বিনষ্ট হয়েছিল ১০ লক্ষাধিক হেক্টর জমির ফসল। সেই ক্ষতির রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেড় বছরের মাথায় ২৫ মে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে আবার ‘আইলা’ নামে আঘাত হানে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। সিডরের তুলনায় আইলায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল কম। তবু অপেক্ষাকৃত সেই কম গতিবেগ, ঘণ্টায় ১২০ কিমি বেগে বয়ে যাওয়া ওই ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১১টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মৃত্যুবরণ করেছিল প্রায় ২০০ মানুষ। মারা গিয়েছিল লক্ষাধিক গবাদি পশু। প্রায় ৭৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়াসহ আড়াই লাখ হেক্টর জমির ফসল হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছিল আড়াই লাখ বাড়িঘর। মোট ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ছিল প্রায় পৌনে তিন লাখ। বলা হয়ে থাকে যে, উপকূলীয় অঞ্চলে পূর্ণ জোয়ারের সময় বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সিডরের তুলনায় আইলায় জলোচ্ছ্বাসজনিত ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। সন্দেহ নেই যে সিডর-আইলা তাদের সর্বাত্মক ধ্বংসক্ষমতা ব্যবহার করতে পারলে এই দুটি ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের জীবন ও সম্পদহানির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে সুন্দরবন দাঁড়িয়ে থাকার কারণে এই দুটি ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ও তার ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস বাধা পেয়েছিল। সুন্দরবন জৈবঢাল হয়ে সিডর-আইলার প্রচ- আঘাতের অনেকটাই আটকে দিয়েছিল। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, একসময় প্রাচীন ভারতবর্ষে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে সুন্দরবন ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত থেকে যে ধরনের শক্ত ও মজবুত জৈবঢাল হয়ে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত, আজ তার সেই শক্তির অনেকটাই কমে গেছে। ত্রয়োদশ শতকে সুলতানি আমলে সুন্দরবন ধ্বংস করে কৃষিকাজ শুরু করায় তখন থেকেই এর আয়তন দ্রুত কমতে শুরু করে। ১৭৯৩ সালে সুন্দরবনের আয়তন হয় ১৪ হাজার ৬২৭ বর্গকিলোমিটার। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ ভারতে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার পর সুন্দরবন ধ্বংস করে কৃষিজমি বের করার প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পায়। তবে একেবারেই তা বন্ধ হয় না। জনসংখ্যার চাপে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে সুন্দরবনের আয়তন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্য থেকে ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার পূর্ব পাকিস্তান অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা আজ বাংলাদেশ সুন্দরবন নামে পরিচিত। বাকি অংশ চার হাজার ২৩৯ বর্গকিলোমিটার ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। সময়ের ব্যবধানে হ্রাসকৃত আয়তনের সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ বিশেষ করে সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, গরান, গেওয়া, হরগোজা প্রভৃতি গাছের ঘনত্ব ও উচ্চতাও হ্রাস পেতে শুরু করে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপজনিত বনজ সম্পদ আহরণ ও ক্ষতিকর দূরত্বের মধ্যে গড়ে ওঠা শিল্প-কলকারখানা ও বনের মধ্যে চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত নৌযান সৃষ্ট দূষণপ্রক্রিয়া এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। এসব কর্মকা-ের ফলে জৈবঢাল হিসেবে সুন্দরবনের শক্তি বর্তমানে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তবুও এখন পর্যন্ত সুন্দরবনের যেটুকু টিকে আছে, তা যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যায় তাহলে সেটুকু দিয়েই বাংলাদেশের উপকূলভাগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস অনেকটাই মোকাবেলা করা সম্ভব। এর সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর ধার দিয়ে গাছের ঘন বেষ্টনী তৈরি করা এবং নদী বরাবর বেড়িবাঁধগুলোর যেখানে- সেখানে কেটে মাছ চাষের জন্য সøুইস গেট নির্মাণ বন্ধ করতে পারলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসজনিত ক্ষতির পরিমাণ আরও হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুন্দরবনই বারবার বাংলাদেশকে বুক পেতে রক্ষা করছে। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘সুন্দরবন বারবারই বাংলাদেশকে ঘূর্ণিঝড় থেকে ঢাল হয়ে রক্ষা করছে। আর উপকূলীয় এলকার সবুজ বেষ্টনীও এই সময় কাজ করে।’ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, ‘সুন্দরবন বরাবরই ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের রক্ষা করেছে। সিডরে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তবে ১২ বছরে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবন আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। আসলে সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল। তাকে বিরক্ত না করলেও সে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠে, সুরক্ষা দেয়। সেখানে তো গাছ লাগাতে হয় না। ওটা একটা প্রাকৃতিক সিস্টেম। একটু ভালো ব্যবস্থাপনা হলেই সে শতাব্দীর পর শতাব্দী এভাবেই টিকে থাকবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান ঘূর্ণিঝড়ের পর বলেন, ‘যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ছিল তা হয়নি। পূর্ব প্রস্তুতি এবং ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। আর এ জন্য সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং এটা যাতে আর কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করব। এই বনের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, বন উজাড় করা হচ্ছে। নানাভাবে বনের ক্ষতি করা হচ্ছে। এটা বন্ধ করে সুন্দরবনকে সুরক্ষা দিতে হবে।’ অথচ সুন্দরবন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ফাইলবন্দী বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে আরও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনে সরকারী প্রকল্পগুলো মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দী হয়ে রয়েছে। ফলে দীর্ঘদিনেও পর্যটকবান্ধব সুন্দরবন গড়ে ওঠেনি। প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ছয়বার রূপ বদলায়। খুব ভোরে এক রূপ, দুপুরে অন্যরকম, পড়ন্ত বিকালে আরেক রূপ, সন্ধ্যায় সাজ নেয় ভিন্ন রূপে। মধ্য ও গভীর রাতে সৌন্দর্য আরেক রকম। আর চাঁদনী রাতে রূপের বর্ণনা দেওয়া কঠিন। সুন্দরবনের মোহনীয় রূপের সাজ পর্যটকদের মোহিত করে তোলে। এ ছাড়া কচিখালী সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ তো রয়েছেই। এ কারণেই দেশী-বিদেশী হাজারও পর্যটক সৌন্দর্যের ক্ষুধা মেটাতে এখানে ছুটে আসেন। কিন্তু ভ্রমণ আরও চিত্তাকর্ষ করতে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা আজও গড়ে ওঠেনি। সুন্দরবন কেন আকর্ষণীয় সুন্দরবনের মোট আয়তনের মধ্যে বনভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ ও জলভাগ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। রয়েছে প্রায় সাড়ে চারশ নদ-নদী ও খাল। সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান, গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিট রয়েছে। বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসস্থল সুন্দরবনে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল-মায়া হরিণ, লোনা পানির কুমির, অজগর, কচ্ছপ, বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বিচরণ চোখে পড়ে। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দেড় লাখ হরিণ, ৫০ হাজার বানর, ২৫ হাজার বন্য শূকর, ২০০ কুমির, ২৫ হাজার উট বিড়াল। ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ জাতের চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির মালাস্কা রয়েছে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি এই সুন্দরবনের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন সুন্দরবনের কটকা-কচিখালী, নীলকমল, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ-মান্দারবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকতের ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর এলাকাকে পৃথিবীর ৫৫২তম বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) হিসেবে ঘোষণা করে। এই সুন্দরবনে প্রতি বছর মধু আহরণ মৌসুমে অন্তত এক হাজার মৌয়াল বনে ঢোকে। তাদের পাশাপাশি জেলে ও বাওয়ালি মিলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এই বনের ওপর নির্ভরশীল। পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন সুন্দরবনের করমজল বন্য ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র, হারবাড়িয়া ইকো সেন্টার, কটকা, কচিখালী ও নীলকমল অভয়ারণ্য, শেখেরহাট টেম্বপল, কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম সেন্টার, মান্দারবাড়িয়া অভয়ারণ্য স্পটগুলো পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত। এসব স্পটে কুমির প্রজনন, অসুস্থ হরিণের পরিচর্যা, হাজার বছরের পুরনো স্থাপনার ধ্বংসাবশেষসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্র্য উপভোগ করা যাবে। পর্যটক ইচ্ছা করলে হেঁটে বনের ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন। ভাগ্য সহায় হলে বানর, হরিণ, গুইসাপ, কাঁকড়া অথবা কুমিরের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য দেখতে পারেন। চলবে... লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×