ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনাকাক্সিক্ষত পরিবহন ধর্মঘট

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২২ নভেম্বর ২০১৯

অনাকাক্সিক্ষত পরিবহন ধর্মঘট

দীর্ঘদিন থেকে রাজধানীসহ দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলন ও দাবির মুখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকরের ঘোষণা এলেও তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আকস্মিক আহূত ধর্মঘটের কারণে। অথচ জাতীয় সংসদে আইনটি অনুমোদনসহ কার্যকরের আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্তরে গণশুনানিসহ মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বহু দেনদরবার, বৈঠক ও মতবিনিময় হয়েছে। সর্বশেষ আইনটি অনুমোদনের পর মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য সরকার তথা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সংযম ও ধৈর্য প্রদর্শন করেছে। নতুন সড়ক আইন সম্পর্কে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও পথচারীদের মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে যানবাহন ও পথচারীদের নিবিড় তদারকির মাধ্যমে আইনটি সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য। এরপরই মাঠে নেমেছে পুলিশ ও মোবাইল কোর্ট, তাও সীমিত পর্যায়ে। সত্যি বলতে কি, আইনটি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোন কড়াকড়ি কিংবা বাড়াবাড়ি দেখানো হয়নি, এমনকি রাজধানীতেও। যৎসামান্য কিছু জরিমানা, মামলা ও মাত্র গুটিকতক যানবাহন জব্দ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলো, এতসব মোটিভেশন কার্যক্রম ও শৈথিল্য প্রদর্শনের পরও হঠাৎ করে বেঁকে বসেছেন প্রায় সব যানবাহন ও পরিবহন মালিকসহ শ্রমিকরা, যাদের মধ্যে রয়েছেন চালক, হেলপার ও অন্যান্য। এতে স্বভাবতই একদিকে যেমন সমূহ বিপাকে পড়েছেন রাজধানীসহ সারা দেশের যাত্রীসাধারণ, জরুরী প্রয়োজনে যাদের চলাচল করতে হয়। অন্যদিকে নিত্যপণ্যসহ বিবিধ পণ্য পরিবহনে দেখা দিয়েছে জটিলতা। পরিবহন মালিক ও চালকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, আইনে দুর্ঘটনার জন্য অজামিনযোগ্য ধারা এবং অর্থদ-ের পরিমাণ বেশি রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, এসব করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষেই। তাহলে তারা পুনরায় আপত্তি তুলছেন কেন? তদুপরি আইন ও বিধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তা না করেই আকস্মিক ধর্মঘটের ডাক ও অবরোধ কেন? তারা কি নিজেদের সবরকম আইন ও জবাবদিহির উর্ধে রাখতে চান? স্বস্তির কথা এই যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর আপাতত ধর্মঘটের অবসান ঘটেছে। বিশ্বে প্রতিবছর ১৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। পঙ্গু ও আহত ততোধিক। এর এক-তৃতীয়াংশ ঘটে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে। গত দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার হয়েছে তিনগুণ, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত তথা শ্লথগতি করে দেয়। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ৬৭ শতাংশ বাংলাদেশী ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী। এ ছাড়া ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর চতুর্থ বৃহত্তম কারণ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত পরিবারগুলোতে একদিকে যেমন নেমে আসে মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে হতে হয় সমূহ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। রাজধানীসহ সারাদেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও ফিটনেস নবায়ন না করা গাড়ির সংখ্যা চার লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি। এর বাইরেও রয়েছে লাইসেন্সবিহীন অথবা ভুয়া বা জাল কাগজপত্রের যানবাহন। মাঝে মধ্যে ঢাকা ও অন্যত্র বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে যানবাহন পরীক্ষা করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্তকরণসহ যানবাহন জব্দ, মামলা দায়েরসহ জেল জরিমানা ইত্যাদি করে না, তা নয়। তবে যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় এর পরিমাণ নগণ্য বলা চলে। জাতীয় মহাসড়কগুলোতে ১৫৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান রয়েছে। রেলক্রসিংগুলো প্রায় অরক্ষিত। সড়কচিহ্ন ও মার্কিংসহ নানা ত্রুটি সর্বত্র। ১৮১ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে জাতীয় মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোয় সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো একটি। সড়ক-মহাসড়কে ইজিবাইক, হোন্ডা, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান, নসিমন, করিমন, লেগুনা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৮-এর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে অনুমোদিত সড়ক পরিবহন আইনটি যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরী।
×