ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী জাতিসত্তার কাব্যিক প্রকাশ, শিকড়ের শক্তিতে বাঁচার অনুপ্রেরণা

প্রকাশিত: ১১:০২, ২০ নভেম্বর ২০১৯

বাঙালী জাতিসত্তার কাব্যিক প্রকাশ, শিকড়ের শক্তিতে বাঁচার অনুপ্রেরণা

মোরসালিন মিজান ॥ জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে গর্ব করে বাংলাদেশ। আর জয়নুল আবেদিন গর্ব করতেন গ্রাম নিয়ে। বাংলাদেশ বলতে, হ্যাঁ, গ্রামকেই বোঝতেন শিল্পাচার্য। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সরল জীবন যাপন, লোকায়ত সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভা-ার তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। নিজের সচেতন চেষ্টায়, চর্চায়, গ্রামকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। লোক ঐতিহ্যকে সবার উর্ধে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর বহু ছবিতে সে প্রমাণ আমরা পাই। তবে একেবারেই আলাদা এবং বিশিষ্টার্থক হয়ে উঠেছিল জয়নুলের আঁকা স্ক্রল পেইন্টিং ‘নবান্ন।’ জলরঙে আঁকা ক্যানভাসে ফসল কেন্দ্রীক সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রধান উৎসবটি দৃশ্যমাণ করা হয়। কৃষকের ধান কাটা, ঘরে আনা, মাড়াইসহ পুরো প্রক্রিয়াটি তুলে ধরেছিলেন জয়নুল। ফসল ঘরে তোলার অবসরে যত উৎসব পার্বণ সব নিখুঁতভাবে এঁকেছিলেন। সেইসঙ্গে বাঙালীকে শিকড়ের শক্তিতে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আজও তার ‘নবান্ন’ বাঙালীকে নিজের পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে শেখায়। বাঁচতে শেখায়। যতদূর তথ্য, বিক্ষুব্ধ সময় ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে এক ডজন চিত্রশিল্পী, কবি ও সাংবাদিক একত্রিত হন। বাংলার লোক সংস্কৃতিকে তুলে ধরার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা। সে লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারিতে শিল্পকলা একাডেমিতে এক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ওই প্রদর্শনী উপলক্ষে বিখ্যাত স্ক্রল ছবিটি এঁকেছিলেন জয়নুল আবেদিন। বাঙালী যখন স্বাধীনতা আদায়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে জাতি, ঠিক তখন জয়নুলের ‘নবান্ন’ শুধু ছবি হয়ে থাকেনি, বরং আপন পরিচয়ে বাঁচার জোর দাবি জানিয়েছে। অমূল্য শিল্পকর্ম এখন সংরক্ষিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। কখনও কখনও বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে দেখা গিয়েছিল ছবিটি। বিশাল এলাকাজুড়ে মেলে ধরা ছবি সত্যি এক বিস্ময়! দীর্ঘ ক্যানভাসে আলাদা আলাদা ফ্রেম। স্বতন্ত্র দৃশ্য। কিন্তু একটি অন্যটির সঙ্গে দারুণভাবে সম্পর্কিত। একসূত্রে গাঁথা। ধারাবাহিক গল্প বলার মতো করে ছবি এঁকে গেছেন জয়নুল। দীর্ঘতম ছবিতে শিল্পাচার্যের স্পেসের ব্যবহার দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রং তুলির আঁচড় যেখানে পড়েনি, সচেতনভাবে ফাঁকা রেখে দিয়েছেন যেটুকু জায়গা, সেটুকুও অনায়াসে মূল শিল্পকর্মের অংশ হয়ে ওঠে। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার ঘরে ঘরে ফসল কেন্দ্রীক যে ব্যস্ততা, উৎসব অনুষ্ঠান আনন্দ হাসিরাশি-সবই অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পাচার্য। শুরুটা হয়েছে ধানকাটা দিয়ে। এখানে তুলির বলিষ্ঠ আঁচড়ে আঁকা শ্রমজীবী মানুষ। পরের দৃশ্যে সেই ধান মাথায় করে বাড়ি ফেরা। ততক্ষণে প্রস্তুত উঠোন। সেখানে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে ধানের আঁটি। চলছে গাছ থেকে ধান আলাদা করার কাজ। এ কাজে কৃষকের সঙ্গে যোগ দিয়েছে গবাদিপশু। ফসল ঘরে তোলার প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ঢেঁঁকিতে শব্দ তুলে কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন তারা। শ্রমজীবী নারীদের বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট। ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হলে শুরু হয় উৎসব পার্বণ। বিয়ের ধুম পড়ে। ছবিতে ঐতিহ্যবাহী পালকি। বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরযাত্রা। তবে এখানেই শেষ করেন না জয়নুল। আরও গভীরে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা তাঁর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। সমৃদ্ধির ইতিহাসের পাশাপাশি তিনি বঞ্চনার কথাও বলতে চান। শেষ চিত্রকর্মটি যেন বলে ওঠে- এই যে সুখ, সুন্দর বেঁচে থাকা, সুন্দর থাকে না সব সময়। নানা প্রতিকূলতার মুখে টিকতে না পেরে নিঃস্ব মানুষ নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শহরমুখী হয়। শুরু হয় দুঃখের জীবন। এভাবে স্ক্রল চিত্রটি আর কেবল নবান্নের হয়ে থাকে না। উৎসব আনন্দকে প্রকাশ করে না শুধু। তৃণমূলের মানুষের গ্রামীণ জীবন সংগ্রামের আলেখ্য হয়ে ওঠে। চিরায়ত বাংলার প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ জীবন ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে ‘নবান্ন’। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের আদি আচার অনুষ্ঠান, জীবনাচরণ কিছুই বাদ যায় না। এভাবে ‘নবান্ন’ বাঙালী জাতিসত্তার পরিচায়ক হয়ে ওঠে।
×