ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

সংস্কৃতিভেদে ন্যায়বিচারের ধারণা

প্রকাশিত: ০৯:১১, ২০ নভেম্বর ২০১৯

সংস্কৃতিভেদে ন্যায়বিচারের ধারণা

সংস্কৃতিভেদে ন্যায়বিচারের ধারণা ভিন্ন হতেই পারে। ন্যায়বিচার সম্বন্ধে পশ্চিমা মতবাদগুলোর সবই গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং তার শিষ্য এ্যারিস্টটলের লেখা থেকে উৎসারিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ন্যায়বিচার ঈশ্বর নির্ধারণ করেছেন। ফলে একে স্বর্গীয় আদেশ-তত্ত্ব নাম দেয়া হয়। যখন সুসংগঠিত বিচারব্যবস্থা ছিল না, তখন সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তাদের কথাই ছিল আইন। স্বাভাবিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেন। কাজেই সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিচার বিভাগের উন্নয়ন হয়েছে, মজবুত হয়েছে ন্যায়বিচার প্রসঙ্গটি। আদালতের বিচারিক কাজে একটি মামলায় সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাবেও মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায় এবং ন্যায়বিচারও মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিযুক্ত হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও পেশ করা যে কত দুরূহ, সে বিষয়ে বাংলাদেশ অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য। তবে এসব দৃষ্টান্ত কোন রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে না। কিন্তু উপরের এসব কিছুই পদ্ধতিগত সঙ্কট। শেষ পর্যন্ত বিচার ভাল হলো না মন্দÑ এই সঙ্কটগুলো তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা হতে পারে, কিন্তু কোনভাবেই মাপকাঠি নয়। যে বিচারক এসব সঙ্কট জয় করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আইন মেনে ন্যায় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, একমাত্র তাকেই ন্যায়বিচারের প্রশ্নে অভিনন্দন জানানো যায়। ন্যায়বিচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার কোন বিকল্প নেই। সাধারণভাবে ন্যায়বিচার বলতে আমরা বুঝি অভিযুক্তকে আদালতের মুখোমুখি করা, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দ- প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত বিচারপ্রার্থীকে আশ্বস্ত করা। কিন্তু বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে- এমন কথা বহুকাল ধরেই জনশ্রুতি রয়েছে। বহুল ব্যবহৃত এ বাক্যটি আমরা জানি। বিলম্বিত বিচারে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন মামলার রায় কেনাবেচার। এ রকম একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতায় একটি প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে দেখা দিতে পারে, তাহলে ন্যায়বিচার কী? আইনশাস্ত্র এবং দর্শনশাস্ত্রে ন্যায়বিচার বলতে কোন ব্যক্তির প্রাপ্য কী হবে এবং তার জন্য ভাল ও মন্দের সঠিক অনুপাত কী হবে, তার তত্ত্বকে বোঝায়। সেই দিক বিবেচনায় ন্যায়বিচারকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা সম্ভব। এদের মধ্যে একটি হলো বিতরণমূলক ন্যায়বিচার, যেখানে সম্পত্তি ও অন্যান্য পণ্য বিতরণ করা হয়। বিতরণমূলক ন্যায়বিচারের তত্ত্বগুলোতে কী বিতরণ করা হবে, কাকে করা হবে এবং সঠিক বিতরণ কী রকম হবে, সেগুলো আলোচনা করা হয়। অন্যটি হলো শাস্তিমূলক বা সংশোধনমূলক বিচার, যেখানে কোন ব্যক্তি মন্দ কাজ করলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। আবার পুনরুদ্ধারমূলক বা ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায়বিচারের তত্ত্বে ভুক্তভোগী ও অপরাধীর চাহিদার কথা চিন্তা করে যা ভাল বা উত্তম, সেটিকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সে কারণেই সাধারণ মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ন্যায়বিচার নিয়ে প্রায়শই নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক শোনা যায়। বিশেষ করে কিছু ব্যক্তি বিশেষ ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়ার চেষ্টা করে। তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন ন্যায়বিচার কোন মামুলি বিষয় নয়। ন্যায়বিচার হচ্ছে এমন একটি নৈতিক আদর্শ, যা প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে ব্যক্তির অধিকারের সুরক্ষা ও অপরাধীদের অন্যায়ের শাস্তিকে সমুন্নত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা। একমাত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলার গতিকে বেগবান করার মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। জনসাধারণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সব মানুষকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনকে হতে হবে যৌক্তিক। আমাদের দেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনকে অবশ্যই হতে হবে স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে গ্রহণযোগ্য। অন্তত একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সেটাই প্রত্যাশিত। কেননা, জনবান্ধব আইন সাধারণ মানুষের আস্থাকে বাড়িয়ে দেয়। একটি সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে আর তা হলো- ন্যায়বিচার ও আইন সমার্থক নয়। ক্ষেত্র বিশেষে আইন অন্যায্যও হতে পারে, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে আইন যদি ন্যায্য না হয়, তবে ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত। বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, ন্যায়পরতা ও সুবিবেচক শব্দসমূহের অর্থ কার্যত ইংল্যান্ডের আইনের মামলাসমূহ ও বিধানাবলি, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সমাজে প্রযোজ্য বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার অনুসারে একটি মামলা নিষ্পত্তি বলতে সাধারণত অনুরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে ইংল্যান্ডের বিধান মোতাবেক নিষ্পত্তি করা বোঝায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ব্যক্তি নিরাপত্তা কাক্সিক্ষত মানের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের চেয়েও বহুগুণ নিচে। একটি সমাজে প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক ঘটনার জন্ম থেকে খুব সহজে অনুমান করা যায় যে, সে সমাজে ন্যায়বিচারের অভাব রয়েছে। আমরা যদি আমাদের আচরণগত সমস্যা দূর করে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে চাই, তবে অবশ্যই আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের দৃষ্টিতে সমতার (ঊয়ঁধষরঃু নবভড়ৎব ষধ)ি বিধানটি সংবিধানে বলা হয়েছে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। আদালতে যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়, সেখানেও অপ্রত্যাশিত বক্তব্য শুনতে পাওয়া যায় মামলার বাদী কিংবা বিবাদীর কাছ থেকে। যে পক্ষ মামলায় পরাজয় বরণ করেন, তিনি সহসাই বলেন- আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শাস্তি হলেও এমন বক্তব্য শোনা যায়। বিষয়টি মোটেও ইতিবাচক নয়; অন্তত আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার প্রশ্নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় ঞযব ওহফবসহরঃু ঙৎফরহধহপব, ১৯৭৫ এর মাধ্যমে। এই আইনটি মৌলিক মানবাধিকার এবং সংবিধানে সংরক্ষিত মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সংরক্ষণ তথা দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উক্ত অধ্যাদেশটি ছিল একটি বড় প্রতিবন্ধক। ১৯৯৬ সালে ওহফবসহরঃু অধ্যাদেশ বাতিল হলে ন্যায়বিচার সমুন্নত করার একটি প্রতিবন্ধকতা জয় করা যায়। লাখ লাখ মানুষ আমাদের দেশে আজও বিচারপ্রার্থী, কিন্তু ন্যায়বিচার ও তাদের সুরক্ষার জন্য আমাদের সম্পদ খুবই সীমিত। মামলা দায়ের ও পরিচালনা করাই যথেষ্ট নয়। ‘ন্যায়বিচার এবং স্বচ্ছতা’- শুধু আদালত বা বিচার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নয়; বরং রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করতে হবে। যদি সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, সেক্ষেত্রে এর সুফল নাগরিকরা পাবেন। এই স্বচ্ছতার ধারণার অন্তর্গত হচ্ছে সাধারণ ন্যায়বিচার এবং তর্কিত কাজের যৌক্তিকতা। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, যদি ‘অঁফর ধষঃবৎঁস ঢ়ধৎঃবস’ নীতি বহির্ভূত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে স্বচ্ছতা ভঙ্গ হবে এবং যদি পক্ষপাতের অভিযোগ থাকে, সেক্ষেত্রে তর্কিত পদক্ষেপ অস্বচ্ছ হবে। এছাড়া যদি খড়ৎফ এৎববহ গজ সংজ্ঞায়িত জবধংড়হধনরষরঃু অনুপস্থিত থাকে, সেক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপটি স্বচ্ছতার আওতায় আসবে না। সুতরাং জীবনের সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের প্রধান বিচারপতি লর্ড হাওয়ার্ড জঠ ঝঁংংবী ঔঁংঃরপব মামলায় বলেছেন- ‘... ঃযধঃ লঁংঃরপব ংযড়ঁষফ হড়ঃ ড়হষু নব ফড়হব, নঁঃ ংযড়ঁষফ সধহরভবংঃষু ধহফ ঁহফড়ঁনঃবফষু নব ংববহ ঃড় নব ফড়হব’ অর্থাৎ ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না সব পক্ষই যেন উপলব্ধি করতে পারে যে, ন্যায়বিচার সুস্পষ্ট ও নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই শাশ্বত উক্তি সমুন্নত রাখার চেষ্টা আমাদের সবারই করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আইনজীবীর প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত আদালতের প্রতি, যাতে করে আদালত আইন মোতাবেক বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারে। পাশাপাশি বিচারকগণের দায়িত্ব সংবিধান এবং আইনের বিধান মোতাবেক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সম্প্রতি ন্যায়বিচারের বিষয়টি একটু ভাবনার অবকাশ সৃষ্টি করেছে। উপরের আলোচনা থেকে এটা প্রতিয়মান হয় যে, আদালতে আইনজীবী এবং বিচারক পরস্পর পরিপূরক। হ্যাঁ, বিষয়টি একদম সঠিক। কাজেই বার ও বেঞ্চর মধ্যে ভাল সমন্বয় ন্যায়বিচারের পথকে প্রসারিত করে। আরেকটি বিষয় সহজে অনুমেয় যে, যদি বার দুর্বল হয়ে যায় তবে আদালতের রায় দুর্বল হবে এবং রায় দুর্বল হলে অনিবার্যভাবে ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে। ন্যায়বিচার ব্যাহত হলে তার খারাপ ফলাফল সমাজ ও রাষ্ট্রের কেউই এড়িয়ে যেতে পারবে না। সুতরাং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। অজ্ঞতা, দোদুল্যমান মানসিকতা, ভুল তথ্য, অপরাধ বোধ, স্ব-প্রবঞ্চনা, নীরবতা, অস্বীকৃতি এবং ভয় অতীতে আমাদের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু আশার কথা এই যে, ধীরে ধীরে এই সব পরিস্থিতি থেকে সমাজ বেরিয়ে আসছে। এটা পরিষ্কার যে, ওই ধরনের না- সূচক পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু অসম্ভব নয়। আর এসব কিছু করার জন্য দরকার সচেতনতা, ন্যায়বিচার প্রশ্নে খোলামেলা আলোচনা। আমরা এটাকে গুরুত্ব না দিলে, আমরা নিজেরাই বিপদের সম্মুখীন হব। লেখক : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক [email protected]
×