ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবস্থাপনার চরম অবহেলায় রেল দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৯ নভেম্বর ২০১৯

ব্যবস্থাপনার চরম অবহেলায় রেল দুর্ঘটনা

যাতায়াত ব্যবস্থায় গণপরিহনের সবচাইতে নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক যাত্রায় রেলের মান নিয়ে সবাই এতদিন নিঃসংশয় ছিল। মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনা একেবারে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। প্রাণহানির শঙ্কাও যে এড়ানো গেছে তেমন বলারও সুযোগ নেই। কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, যান্ত্রিক ক্রটি বিচ্যুতিই শুধু নয়, চালকের অদক্ষতা সব মিলিয়ে রেল দুর্ঘটনার হার কম হলেও আরও অনেক কারণে বিপন্নতার শিকার হতে হয় রেল যাত্রীদের। তারপরও যাত্রা বিশেষ করে দূরযাত্রার মাধ্যম হিসেবে সিংহভাগ মানুষই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও আরামদায়ক গণপরিবহন হিসেবে রেলকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এই রেলযাত্রাও সবসময় সুখকর কিংবা নির্বিঘœ হয় তেমনটাও নয়। এক সময়ের প্রচলিত প্রবাদ নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে? এই আর এক দুর্ভোগ যথাসময়ে আরম্ভ হওয়ার যাত্রা অকারণে, অপ্রয়োজনে বিলম্বিত করা। সেটাও কেমন যেন কর্তৃপক্ষের এক ধরনের অবহেলা কিংবা অব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র। কোন কারণে ট্রেন যদি নির্দিষ্ট সময়ে তার যাত্রা শুরু করতে ব্যর্থ হয় তাহলে পুরো ভ্রমণটাই হয়ে ওঠে বিপত্তিকর। কারণ সিডিউল বিপর্যয়ের খেসারত দিতে হয় সারা পথে। আবার মাঝপথে রেলপথ সংস্কারের দুর্ভোগে পড়লে তো কখন পৌঁছানো যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে তা ধারণা করাও মুশকিল। সবচাইতে দুঃসহ পরিস্থিতির শিকার হতে হয় তখনই যখন কোন ট্রেন মাঝপথে থমকে যায়। যাত্রীরা জানতেও পারে না মূল সমস্যাটা আসলে কোথায়? ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে কিছু জানতে চাইলেও কোন সদুত্তর কখনই পাওয়া যায় না। যারা রেলযাত্রাকে স্বচ্ছন্দ এবং স্বাভাবিক ভেবে বগিতে চেপে বসেন তাদের এমন অভিজ্ঞতা হরমামেশাই হয়ে থাকে। আবার সেসব ধকল সামলাতে গিয়ে যখন ট্রেন পুনরায় তার গতি ফিরে পায় তা পরে যে দ্রুত গতিতে চলে তাও মনে হয় কোন নিয়মকানুন ছাড়াই রেল চলছে। আর এটাই হলো প্রতিদিনের রেল আসা-যাওয়ার চিত্র। যা কোন দুর্ঘটনার আওতায় পড়ে না বলে গণমাধ্যমে সেভাবে খবরও হয় না। এ তো গেল রেলযাত্রার ইতিবৃত্ত। আবার এই রেলই সড়ক ব্যবস্থাপনাকে যে কতখানি দুর্বিষহ করে তোলে তেমন চিত্রও সব সময়ই দৃশ্যমান। বিভিন্ন সড়কের মাঝখানে রেল লাইনের যে স্থান সেখানেও ঘটে হরেক রকম বিপত্তি। যেমন সড়কের মধ্যিখানে যখন ট্রেন আসার সময়ে হয় তেমন সংযোগস্থলে সঙ্কেত চিহ্ন কিংবা লম্বা কাঠের তৈরি পিলার দিয়ে লাইনের নির্দিষ্ট জায়গাটি আটকে দেয়া। ফলে দুই পাশের সড়কে যাত্রীবাহী সকল যান থেমে যায়। এমনও দেখা যায় মাঝে মধ্যে রেল লাইনের উপরই সাধারণ যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কারণে যদি রেল আসা শুরু করে তাহলে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় কত যে জানমালের ক্ষতি হবে তা অনুমান করাও কষ্টকর। চলন্ত ট্রেন গতি থামানোর স্বাভাবিক নিয়মেই তার চলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চট করে ট্রেন গতি নিয়ন্ত্রণ করে থামাতেও পারে না। আর এমন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো কেন কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় অরক্ষিত থাকে বলা মুশকিল। ট্রেনের সঙ্গে সড়ক যানের সংঘর্ষও কম নয়। আবার ট্রেনের নিচে কাটা পড়া মানুষের সংখ্যাও হাতে গোনার মতো নয়। তাই বলাই বাহুল্য, এমন নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক এবং আরামদায়ক ভ্রমণটি সব সময়ই শঙ্কা আর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তার যাত্রাপথ অতিক্রম করে। পরস্পর দুই ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ ছাড়াও রেল ব্যবস্থাপনার অনিয়ম, অসঙ্গতি এবং গাফিলতির খেসারত দিতে হয় অতি সাধারণ পথযাত্রী কিংবা পরিবহন যাত্রীকে। তবে একথাও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ কিংবা নদীপথ যাই হোক না কেন যাত্রার মাধ্যম, সবখানেই ব্যক্তি সচেতনতা কিংবা কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা ছাড়াও নিয়মমাফিক চলার বিধি নিষেধও অত্যন্ত জরুরী। উন্নয়নের নিরন্তর যাত্রায় বাংলাদেশ আজ ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির ধারায়। সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া সার্বিক প্রবৃদ্ধি কখনও দৃশ্যমান হয় না। সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথকেও আধুনিকতার সম্ভাবনায়ময় জগতে সম্পৃক্ত করতে সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। দেশের মহাসড়কগুলোতে চার লেনের সংযোগস্থল কিংবা সেতু, উড়াল সড়ক নির্মাণ কিংবা নির্মাণাধীন অবস্থান আজ দৃশ্যমান। একইভাবে রেলপথকে নতুন সময়ের নবদিগন্তে এগিয়ে নিতে হরেক রকম প্রকল্প সরকার এগিয়ে নিচ্ছে। নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের মেগাপ্রকল্পও আজ তার নতুন কাঠামো জনগোষ্ঠীকে জানান দিচ্ছে। আধুনিকতার বিস্তৃত বলয়ে যাতায়াত ব্যবস্থায় যে নতুন মাত্রা তাকে আরও সংহত করতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকেও বিশেষ জোরদার করা একান্ত আবশ্যক। ভেতরের ত্রুটি-বিচ্যুতি, গাফিলতি এবং বিশৃঙ্খল অবস্থাকে জিইয়ে রেখে বাহ্যিক সুন্দর কাঠামো পুরো ব্যবস্থাপনার যথার্থ সঙ্কট নিরসনে কার্যকর হতে বিলম্বিত হবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মারাত্মক ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রাম থেকে আগত তূর্ণানিশীথা এক্সপ্রেসের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সিলেটের উদয়ন এক্সপ্রেসের। এতে ১৬ জনের মৃত্যু হয় এবং শতাধিক আহত এখনও বিপদের ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত নয়। মাত্র তিনদিনের মাথায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হলে আগুন ধরে যায়। দুটো অনাকাক্সিক্ষত ট্রেন দুর্ঘটনাকে মূলত তদন্তে নামা কর্মকর্তারা কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং মারাত্মক গলদ বলে মনে করছেন। বলা হচ্ছে, সিংহভাগ দুর্ঘটনাই কর্তৃৃপক্ষের প্রয়োজানীয় নজরদারির চরম গাফিলতির কারণেই ঘটছে। ট্রেনের এমন সব মারাত্মক বিপর্যয় মূলত ঘটে থাকে দুটি প্রধান কারণে। প্রথমত ব্যক্তিগত অসর্তকতা, যথার্থ ব্যবস্থাপনার চরম ঘাটতি, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব। দ্বিতীয়তÑ যান্ত্রিক ক্রুটি বিচ্যুতি যা রেললাইন থেকে আরম্ভ করে ট্রেনের সামগ্রিক বগি ব্যবস্থাপনার চরম অসঙ্গতি। শুধু তাই নয়, ইঞ্জিন বিকল হওয়ার মতো অস্বাভাবিক ব্যবস্থাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ভুল সঙ্কেত দেয়া, ট্রেনের লাইন পাস করার সংযোগ জায়গাটির অনিয়ম, অসঙ্গতি যে কোন সময় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন। এ ছাড়াও চালকের অদক্ষতা, সঙ্কেত নির্দেশের অমান্যতা, গতি নিয়ন্ত্রণের নির্ধারিত নির্দেশনাকে অবহেলা করা ছাড়াও প্রশিক্ষিত কর্মীদের ঘাটতি ট্রেন ব্যবস্থাপনার মহাসঙ্কট। এ ছাড়া আছে শাস্তি প্রদানে চরম পক্ষপাতিত্ব এবং আইনকে তোয়াক্কা না করার দুঃসাহস। যে কোন বড় দুর্ঘটনায় শাস্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হয় ছোট কর্মীরা। উর্ধতন কর্মকর্ত যারা আসলেই সত্যিকারের দোষী তারা যে কোনভাবেই হোক আইনের ফাঁক ফোকড়ে বের হয়ে যায়। শাস্তির এই অনিয়ম এবং বৈষম্য নতুন অপরাধের মাত্রা তৈরি করতে দেরি করে না। অভ্যন্তরীণ এই সব সঙ্কটকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে ব্যর্থ হলে সমস্যা যে তিমির সেখানেই থেকে যাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ট্রেন দুর্ঘটনাকে প্রধানমন্ত্রী চালকদের অদক্ষতাকেও নির্দেশ করেছেন। শুধু তাই নয়, পুরো ব্যবস্থাপনায় আরও প্রশিক্ষণ ও কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর ওপরও বিশেষ জোর দেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের চালক এবং সহকারী দু’জনেই ঘুমিয়ে থাকতে পারে কিংবা এমন বেসামাল অবস্থায় ছিল যাতে কোন সঙ্কেত নির্দেশও তাদের সচেতন করতে পারেনি। এমন দুর্বিষহ অবস্থায় যাত্রীদের প্রাণসংহার ছাড়াও জাতীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবও নেই। আর শতাধিক আহতের স্বাভাবিক, সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। শুধু আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে এত বড় ক্ষতি পূরণ করা একেবারে অসম্ভব। এমন সব দুর্ঘটনার ক্রটি-বিচ্যুতি বের করতে গিয়ে আরও অনেক দুঃসহ চিত্র সামনে চলে আসে। রেলের মতো দেশের সর্বব্যাপী এই যাত্রী পরিবহন প্রতিষ্ঠান নাকি বছরে প্রায়ই দেড় হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনছে। এমন দুরাবস্থার শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন অতিরিক্ত অদক্ষ লোকবল নিয়োগ পুরো ব্যবস্থাপনাকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে। এ ছাড়া আছে উর্ধতন কর্তাব্যক্তিদের বড় কোন উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষ মনোসংযোগ। যার কারণে মূল দায়িত্বে অবহেলা ব্যবস্থাপনা সংকটকে তীব্র করে তুলছে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নিরাপদ ভ্রমণ হিসেবে রেলপথকেই বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা শুরু করতে না পারা থেকে শুরু করে ক্রসিং-এ পড়ে অযথা সময় নষ্ট কিংবা মাঝপথে ট্রেন বিকল হয়ে যাওয়া এমন সব ত্রুটি বিচ্যুতিকে উপেক্ষা করেও সাধারণ যাত্রীরা রেলপথে ভ্রমণকেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে আসছে এখন পর্যন্ত। পর পর এভাবে দুর্ঘটনায় পড়তে থাকলে এই নিরাপদ যাত্রাটি কোন এক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনায় আরও দুরবস্থা নেমে আসা অমূলক নয়। সুতরাং এমন যাত্রাপথকে সর্বসাধারণের কল্যাণে উপযোগী করে তুলতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আরম্ভ করে রেল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সচেতন নজরদারিব সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে নতুন মাত্রা যোগ করা এই মুহূর্তে সব থেকে জরুরী। জনবান্ধব এমন কল্যাণমুখী রেলওয়ে প্রতিষ্ঠানকে ক্রুটি বিচ্যুতির আবর্তে ফেলে রেখে দেয়া যাবে না। এর সার্বিক উন্নয়নে যা যা করা দরকার বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সবটাই করা জনস্বার্থেই প্রয়োজন। লেখক : সাংবাদিক
×