ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কলাপাড়ায় পুকুর ভরাট-দখলের হিড়িক

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০১৯

কলাপাড়ায় পুকুর ভরাট-দখলের হিড়িক

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ॥ সাগরপারের জনপদ উপকূলীয় কলাপাড়ায় পুকুর ভরাটের হিড়িক চলছে। গত এক যুগে এখানে অন্তত দুই হাজার পুকুর ভরাট করা হয়েছে। অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়ার স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানা পুকুর ভরাটের পাশাপাশি দখল-ভরাট থেকে বাদ পড়ছে না সরকারী খাস পুকুর। আর এর ভয়াবহ বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে গোটা উপকূলজুড়ে। ফলে গোসল, রান্নাসহ নিত্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারন করেছে। পানির সঙ্কটে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে ডায়রিয়াসহ নানান ধরনের রোগ বালাইয়ে। সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, কীভাবে পুকুর ভরাট করা হয়েছে। পুকুরগুলো ভরাট করে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তোলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পুকুর ভরাট হয়েছে কলাপাড়া পৌর শহরে। এখানে অন্তত চার শ’ পুকুর ভরাট করা হয়েছে। ড্রেজার লাগিয়ে বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে তোলা হয়েছে স্থাপনা। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এসব পুকুরের পানি মালিকসহ আশপাশের পড়শিরা গোসল, রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে পৌরশহরে পৌরসভার পানির সরবরাহ এক দিন বন্ধ থাকলে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। মানুষ চরম বিপাকে পড়ছেন। ব্যক্তি মালিকরা পুকুর ভরাট করা ছাড়াও সরকারি বেসরকারি সংস্থাও পুকুর ভরাট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন পৌর শহরের এতিমখানা পুকুরটি ভরাট করে সেখানে পৌর ভবন তোলা হয়েছে। ওই পুকুরটির পানি প্রতিদিন অন্তত হাজারো মানুষ গোসল রান্নাসহ নিত্যকাজে ব্যবহার করত। বর্তমানে শহরের অফিস মহল্লায় খাসপুকুরটির আংশিক ভরাট করে সেখানে উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। এভাবে প্রয়োজনে এবং বিনা প্রয়োজনে শহরের পুকুর ভরাট চলছে দেদার। একই অবস্থা ১২ ইউনিয়নের প্রত্যেক গ্রামে। পুকুর ভরাট করে এই অঞ্চলে মানুষ বসবাসের চিরচেনা বাড়িঘরের আদল বদলে ফেলছে। পুকুর ভরাটের কারনে ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার। চাপ পড়ছে গভীর নলকূপের উপরে। গোসলের সময় ভিড় লেগে যায়। ইতোমধ্যে শতাধিক গভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। পানির স্তর ইউনিয়নভেদে তিন থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে গেছে। পুকুর ভরাটের কারনে ব্যবহারের পানির সঙ্কটে গ্রামাঞ্চলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। পটুয়াখালী বরগুনা মৎস চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প পরিচালিত ১৯৯৮ সালের এক জরিপের তথ্যমতে কলাপাড়ায় মোট পুকুর সংখ্যা ১৭ হাজার এক শ’ ৩৪ টি। এর মধ্যে বড় পুকুর (এক হাজার বর্গ মিটারের বেশি) ছিল ১৫৬৪টি। মাঝারি পুকুর ১০ হাজার ৫৪ টি। ছোট পুকুর ছিল পাঁচ হাজার দুই শ’ ৭৮টি এবং ডোবা ছিল ২৩৮টি। এছাড়া খাস পুকুর ছিল ১০৮টি। কিন্তু বর্তমানে অর্ধেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ওই তথ্যমতে কলাপাড়া পৌর শহরের পুকুর সংখ্যা ছিল ৬৪০টি। যার দুই তৃতীয়াংশ ভরাট হয়েছে বলে দাবি পৌরবাসীর। লতাচাপলী ইউনিয়নের দৃশ্য একই। সেখানে ওই সময় পুকুর ছিল ১৮৮০টি। যার দুই তৃতীয়াংশ ভরাট করা হয়েছে। কুয়াকাটার অবস্থান লতাচাপলীতে হওয়ায় সেখানকার ব্যক্তি মালিকানাসহ সরকারি খাস পুকুর পর্যন্ত ভরাট করে বিক্রি করা হয়েছে। কুয়াকাটার মাঝিবাড়ি এবং খাজুরা এলাকায় শরীফপুর এলাকাজুড়ে পুকুরের পাশাপাশি সরকারি অন্তত ৫টি দীর্ঘ খাল ভরাট করে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দখল পর্যন্ত বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে এখন ব্যবহারের পানি তো দুরের কথা। মানুষ বসবাস করাও দুরুহ হয়ে গেছে। সেখানকার হাজারো লোকজন দুই বছর আগে এসবের প্রতিবাদে মানবন্ধন পর্যন্ত করেছে। মিঠা পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে সেখানে একদফা সংঘাত হয়েছে। কলাপাড়া পৌরসভায় সরকারি হিসাবে ২৪টি খাস পুকুর রয়েছে। তার অর্ধেক এখন ভরাট হয়ে গেছে। নাচনাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় একটি খাস পুকুর ভরাট করে সেখানে এখন ফ্রি-স্টাইলে তোলা হয়েছে স্থাপনা। লতাচাপলীর রাখাইন পল্লী কালাচানপাড়ায় সরকারি খাস পুকুর দখল করে সেখানে বহুতল মার্কেটসহ অসংখ্য স্থাপনা তোলা হয়েছে। পুকুর দু’টির পানি এখন দুষিত। মানুষ বর্জ্য ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। ১৯৭১ সালের হিসাব মতে কলাপাড়ায় মোট পুকুর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬৬৩ টি। এর পরে এই এলাকার মানুষ স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন এবং ব্যবহারের নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা বিধানকল্পে বাড়ির সামনে পেছনে দু’টি করে পুকুর খনন করেছে। কিন্তু বর্তমানে ফ্রি-স্টাইলে তাৎক্ষণিক লাভের আশায় পুকুর ভরাট করে নিরাপদ পানির ব্যবহারে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রাকৃতিক জলাধার আইনানুসারে কোন ধরনের পুকুর ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আইনের প্রয়োগ নেই। পৌরপরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন নিরাপদ পানির উৎস পুকুর দেদার নষ্ট হয়ে গেলেও তারা রয়েছেন নির্বিকার। কোথাও কোন আইনের প্রয়োগ নেই। সামাজিক কোন দায়বদ্ধতা পর্যন্ত নেই। কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ চিন্ময় হাওলাদার জানান, পুকুর ভরাটে নিরাপদ পানির সঙ্কট রয়েছে। এর ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগব্যধি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি জীবন যাপনে ভয়াবহ বিপর্যস্ত পরিবেশের শঙ্কা রয়েছে। পরিবেশ বিশেষঞ্জের মতে পৌর এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে পুকুর খনন কিংবা ভরাটের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া কত সংখ্যক মানুষের ব্যবহারের জন্য কতটি পুকুর দরকার তা সংরক্ষণের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের। এব্যাপারে কলাপাড়া পৌর মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার জানান, পরিকল্পিতভাবে যেসব পুকুর জনস্বার্থে সংরক্ষণ করা দরকার তা রক্ষার্থে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কুমারপট্টির পুকুরটি দৃষ্টিনন্দন শোভাবর্ধণ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া মশা সৃষ্টিকারী যেসব ব্যক্তিগত পর্যায়ের ডোবা রয়েছে, দুষিত পানি থাকছে তা ভরাট করতেও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মুনিবুর রহমান জানান, যেসব খাস পুকুর বেদখলে রয়েছে তা উদ্ধার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি পুনর্খননের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
×