বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার বুকে। কালক্রমে মানুষ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোন সময় এবং আফ্রিকার ঠিক কোথায় আদি মানবের উৎপত্তি ঘটেছিল তা নিয়ে মতান্তর আছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এক নতুন তথ্য। সেটা হলো বতসওয়ানার মাকগাদিকগাদি এলাকা।
মাকগাদিকগাদি একটি সাদা লবণের স্তর আবৃত সমভূমি যা বছরের অধিকাংশ সময় অত্যধিক শুষ্ক থাকে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে এই প্রাণহীন নীরস এলাকাটি সহসাই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে ওঠে। এই এলাকার সড়ক দিয়ে আরও অগ্রসর হলে পৌঁছে যাওয়া যাবে মাউন নামক স্থানে। এলাকাটি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের চতুর্থ দীর্ঘতম নদী ওকাভাংগোর সবুজ শ্যামল বদ্বীপের প্রান্তে। দুই লাখ বছর আগে মাকগাদিকগাদি এলাকাটিও ছিল সবুজ শ্যামলে ঢাকা। মাকগাদিকগাদি ও বদ্বীপ অঞ্চল ছিল একটা হ্রদের অংশ। তখনকার আফ্রিকার বৃহত্তম হ্রদ। এই হ্রদের চারদিকে ছিল জলাভূমি। বন্যপ্রাণীর জন্য এ ছিল স্বর্গবিশেষ। আর সর্বশেষ গবেষণার দাবি যদি সঠিক হয় তাহলে এলাকাটি মানুষের জন্যও স্বর্গ ছিল। মানুষের উৎপত্তির এক বিচিত্র অধ্যায় সেখানে মঞ্চস্থ হচ্ছিল।
হোমো সেপিয়ান বা মানুষেরা যে আফ্রিকার এক প্রজাতি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ ১৯৮০ এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এলাম উইলসন হাজির করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত তত্ত্বটি মাইটোকন্ডিয়াল ঈভ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তিনি একটি বিশেষ ধরনের ডিএনএ পর্যবেক্ষণ করে তার উপসংহারে পৌঁছান। ডিএনএটি যৌন প্রজননের মাধ্যমে অবিমিশ্র অবস্থায় মা থেকে তাদের সন্তানদের মধ্যে চলে যায়। এই মাইট্রোজেনোম দেহকোষের নিউক্লিয়াস ছাড়াই থাকতে পারে। মাইট্রোকন্ডিয়া বলে অভিহিত কাঠামোর মধ্যে বাস করে। এই কাঠামোগুলো এক সময়কার মুক্ত জীবনযাপনকারী ব্যাকটেরিয়ার বংশধর। মাইটোকন্ডিয়া এখন দেহকোষের শক্তি হিসেবে মিথোজীবী রূপে কাজ করে।
উইলসনের গবেষণায় দেখা গেছে যে বর্তমান কালের মানব মাইটোজেনোমগুলো হাজার হাজার বছর ধরে মিউটেশন বা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হলেও এমনভাবে এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয় যে তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তাদের অভিন্ন পূর্বপুরুষ আফ্রিকায় বাস করত। সেজন্যই নামটা দেয়া হয়েছে মাইটোকন্ড্রিয়ান ঈভ। তাই বলে সেই মহিলা কোনভাবেই প্রথম মানবী ছিল না। তবে এখন আমরা যারা বেঁচে আছি তারা প্রত্যেকেই দাবি করতে পারি যে সেই মানবী থেকেই আমাদের উৎপত্তি।
ঈভের ক্ষেত্রে যা সত্য তা আদমের ক্ষেত্রেও সত্য। ওয়াই ক্রোমোজমের ডিএনএর অংশবিশেষ অবিমিশ্র অবস্থায় পিতা থেকে পুত্রের মধ্যে চলে যায়। সেই ডিএনএ দিয়েও অনুরূপ এক ঠিকুজি তৈরি করা যায় যার শিকড় রয়েছে আফ্রিকায়। সেই ওয়াই ক্রোমোজমধারী আদম ঠিক কোথায় বাস করত তা এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। তবে অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক লক্ষ্য করেছেন যে মাইটোকন্ডিয়ান ঈভ কিংবা অন্তত তার নিকটাত্মীয়রা হাজার হাজার বছর ধরে বোতসওয়ানার উত্তরাঞ্চলের চমৎকার বিচ্ছিন্ন এক এলাকায় বাস করত।
বতসওয়ানার উত্তরাঞ্চল যে আদি মানবের বাসস্থান ছিল তা বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীদের জানা। মাকগাদিকগাদিতে যুগ যুগ আগে প্যালিওলিথিক হোমিনিডদের ফেলে যাওয়া পাথরের হাতিয়ারপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নির্দিষ্ট কোন হোমিনিডদের হাতিয়ারপাতি তা অবশ্য পরিষ্কার নয়। এসব হাতিয়ার প্রায় ১৮ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাসরা আবিষ্কার করেছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে হোমো ইরেকটাস হলো আদি মানব যারা আফ্রিকা ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের হাতিয়ারপাতি এদের অসংখ্য কন্যা প্রজাতিও ব্যবহার করেছিল। বলাবাহুল্য হোমো ইরেকটাসের একটি শাখা থেকে শেষ পর্যন্ত হোমো সেপিয়ানের উৎপত্তি।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষক ভ্যানেসা থাইস ও তার সহকর্মীরা যা বলতে চেয়েছেন তা হলো মাকগাদিকগাদি হ্রদের চার পাশের ভূখন্ডে আগে যারাই বাস করুক না কেন ২ লাখ বছর আগে সেখানে হোমো সেপিয়ানরা থাকত। পরবর্তী ৭০ হাজার বছর মরুভূমিসদৃশ পরিপার্শ্বের দ্বারা অবরুদ্ধ এ আবাসভূমিতে এ শ্রেণীর মানুষের বিচ্ছিন্ন একঘরে অবস্থায় বিবর্তন ঘটে চলে। তারপর দুই দফা ঝটিকার মতো এই মানুষগুলি বৃহত্তর বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে- একবার ১ লাখ ৩০ বছর আগে এবং আরেকবার ১ লাখ ১০ হাজার বছর আগে।
কেন ও কিভাবেই বা সেটা হয়েছিল সে প্রশ্নের জবাবে গবেষক দলের ব্যাখ্যা হলো স্থানীয় আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে সেই অবরুদ্ধ বাসভূমি থেকে বহির্মুখী উর্বর সবুজ করিডর সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর সেই করিডর দিয়ে আদি মানবরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এবং কালক্রমে আফ্রিকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।’
অস্ট্রেলিয়ার জিনবিজ্ঞানী অধ্যাপক ভ্যানেসা থাইস বলেন, কিছুকাল আগে থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে এনাটমির দিক থেকে বিচার করলে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকায় মোটামুটি ২ লাখ বছর আগে। তবে যে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে তা হলো আমাদের আদিমতম পূর্ব পুরুষরা আফ্রিকার ঠিক কোন জায়গায় আবির্ভূত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তারা কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভ্যানেসা হাইসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেই স্থানটি ছিল বোতসওয়ানার উত্তরাঞ্চলে জাম্বেসী নদীর অববাহিকার দক্ষিণে। আমাদের পূর্ব পুরুষরা মাকগাদিকগাদি নামক বিশাল হ্রদের কাছে বসতি স্থাপন করেছিল। এখন সেই হৃদটা সুবিস্তৃত লবণাক্ত সমভূমি। সে এক বিশাল জায়গা। জায়গাটা ছিল বেশ বর্ষণসিক্ত, শ্যামলিয়া ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। সে সময়কার আদি মানব ও বন্য প্রাণীদের জন্য এ ছিল এক আদর্শ আবাসস্থল। প্রায় ৭০ হাজার বছর সেখানে বসবাস করার পর আদি মানব সেখান থেকে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। গোটা অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের ফলে মানুষ স্থানান্তরিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। এ সময় সবুজ উর্বর জমির কিছু করিডর খুলে যায়। আমাদের পূর্বপুরুষরা দুই দফা ঢলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানান্তর গমনের প্রথম ঢলটি ঘটেছিল ১ লাখ ৩০ হাজার বছর আগে। এরা উত্তর-পূর্বদিকে গমন করে। ১ লাখ ১০ হাজার বছর আগে দ্বিতীয় ঢলে বেরিয়ে আসা আদি মানবরা যাত্রা করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। তৃতীয় জনগোষ্ঠী ঐ স্থানেই থেকে যায় এবং তাদের বংশধরেরা আজও অবধি সেখানে বা তার কাছাকাছি জায়গায় রয়ে গেছে। তাদের দেহাবশেষের অনেক জীবাশ্ম সেখানে পাওয়া গেছে। এদের ডিএনএতে সেই একই মাইটোজেনম পাওয়া গেছে। এদের বংশে ঠিকুজির একটি শাখা এলও নামে পরিচিত।
এই গ্রুপটি বহুলাংশে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এটা খোয়েশান জনগোষ্ঠীর মাইটোজেনমগত বৈশিষ্ট্য। আফ্রিকার আরও উত্তর থেকে বান্টু জনগোষ্ঠী এবং বিদেশ থেকে ইউরোপীয়দের এখানে আগমনের অনেক আগে এই খোয়েশান জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বাস করত। সেখানে তারা বসবাস করত বলে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে তাহলো বোতসওয়ানার উত্তরাঞ্চল। এই এলও মাইটোজেনোমের অধিকারী মানুষরাই প্রায় ৭০ হাজার বছর ধরে এই স্থানটিতে বাস করত।
ড. হাইসএর সহযোগী দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানের বেসিক সায়েন্স ইনস্টিটিউটের এনেক্স টিমাবম্যান আরেক দিক দিয়ে হাইসের ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেছেন। ইনি একজন জলবায়ুবিজ্ঞানী যিনি লুবাতাত্ত্বিক যুগের ভৌগোলিক অবস্থা, মাকগাদিকগাদি এবং এর চারপাশের ইতিহাসের তথ্য প্রমাণাদি সূত্রবদ্ধ করেছেন। বিশেষভাবে তিনি পৃথিবীর কক্ষপথ এবং অক্ষরেখার আবর্তনের পরিবর্তনের কারণে সেখানকার জলবায়ুর ওপর প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এই উপসংহার টেনেছেন যে বেশির ভাগ সময় মাকগাদিকগাদি হ্রদের চার পাশটা ছিল মরুভূমি। কিন্তু চারপাশের এই মরুর দেয়াল দুবার ভেদ করে সবুজ করিডর সৃষ্টি হয়েছিল এবং এ সবুজ করিডর দিয়ে মানুষজন ও জীবজন্তু স্থানান্তর গমন করতে পেরেছিল। প্রথম করিডরটি ১ লাখ ৩০ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখে এবং দ্বিতীয় করিডরটি ১ লাখ ১০ হাজার বছর আগে উত্তর-পূর্ব দিকে উন্মুক্ত হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মাইটোজেনোমিক এবং জলবায়ুগত উপাত্ত একত্রে মিলে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী করিডর দিয়ে যারা ছড়িয়ে পড়েছিল তারা ছিল আজকের এলও মাইটোজেনমধারী মানুষদের পূর্বপুরুষ যারা আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য অংশে চলে যায়। এই স্থানান্তর গমনের অল্প কিছুকাল পর দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল বরাবর মানুষের বসতি কেন গড়ে উঠেছিল এর একটা ব্যাখ্যা এ থেকে পাওয়া যাবে।
উত্তর-পূর্বমুখী করিডর দিয়ে যারা বেরিয়ে গিয়েছিল মাকগাদিকগাদির সেই আদি পুরুষদের সন্তান সন্ততিরা বৃহত্তর বিশ্বে গিয়ে উপস্থিত হয়। তাদের বংশধরেরা এখন যা জাম্বিয়া নামে পরিচিত সেই এলাকা দিয়ে আফ্রিকার বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকার ওয়াই ক্রোমোজমধারী আদমের বংশধরসহ আগে থেকে যেসব মানবগোষ্ঠী বাস করত তাদের সঙ্গে এদের আন্ত প্রজনন ঘটে এবং মানবজাতির এক বৃহত্তর জিন পুলে তারা একীভূত হয়ে যায়।
সূত্র : দি ইকোনমিস্ট