ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিউলি-গন্ধরাজ এবং নবান্নে কৃষকের হাসি

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ১৮ নভেম্বর ২০১৯

 শিউলি-গন্ধরাজ এবং নবান্নে কৃষকের হাসি

‘আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি’ নির্মলেন্দু গুণের ‘স্ববিরোধী’ কবিতার এই দুই চরণ সবার জন্মজীবন বোধের সাক্ষী হতে পারে না। কারণ কিছু কিছু জীবন বিকশিত হওয়ার পূর্বেই চরম নৃশংসতায় লুট হয়ে যায়। তখন ফুলের বাগান মিথ্যে হয়ে যায়, পাখি গাইতে ভুলে যায়, কবিতাও ছন্দ হারায়। প্রস্ফুটিত হওয়ার পূর্বেই উর্দি-বুটের থাবায় লুট হওয়া সেই স্বপ্নের নাম বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠতম পুত্র শেখ রাসেল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় রেহাই পায়নি শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। শিউলি-গন্ধরাজের সুবাস নিয়ে, নবান্নে কৃষকের মুখে হাসির কারণ হিসেবে ১৯৬৪ এর ১৮ অক্টোবর জন্ম নেয়া রাসেলের জীবন প্রদীপ সেদিন নিভে যায় এক লহমায়। ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ি বনে যায় কৃতঘ্ন বাঙালীর করা মহাশ্মশান। মৃত্যুকে দেখে হয়ত ফিরে আসবার সুযোগ নেই। তাই প্রায় প্রত্যেকেই জন্মকে স্বাগত জানায়। যদিও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং লৈঙ্গিক রাজনীতি ভেদে তা বদলেও যায়। কিন্তু সব ছাপিয়ে গর্ভধারিণী মায়ের ‘কষ্ট সমুদ্র’ স্বর্গ সুখে বদলে যায়, যখন তার জন্ম নেয়া শিশু তাঁর পাশে কেঁদে ওঠে এবং এই একবারই মা তার সন্তানকে কাঁদতে দেখেও হাসেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও হয়ত ওই একদিন রাসেলের কান্নায় নিজে হেসেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মতিথি বেশ স্পন্দিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে। কারণ সবে হাঁটতে শিখে যাওয়া এবং জীবন যুদ্ধে দৌড়াতে পারা মানুষগুলোর মাঝে একজন নতুন শিখতে আসা প্রাণ এসেছে, এ যেন তাদের মুহূর্তগুলোকে উদযাপনের নতুন উপলক্ষের সন্ধান পাওয়া। এই আহ্লাদের সূচনা ঘটে বড় বোন শেখ হাসিনার দ্বারা। রাসেল জন্মের পর নিজের ওড়না দিয়ে ভেজা মাথা পরিষ্কারের মাধ্যমে। যদিও সন্তান হিসেবে বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবার সুযোগ তার কমই ছিল। কারণ মা-মাটি এবং মানুষের ভাত-ভোটের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই তাঁকে ঘরের বাইরে থাকতে হয়েছে। জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তাছাড়া রাসেলের জন্ম এবং শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠার ওই সময়টা ছিল ‘বাংলাদেশ অর্জনের’ একেবারে কংক্রিট সময়। তবে এরপরও পিতা হিসেবে তিনি সুযোগ পেলেই আদর করে বুকে ধরে রাখতেন রাসেলকে। রাসেলের নামকরণেও করেছিলেন নিজের পছন্দের দার্শনিক এবং ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে। বার্ট্রান্ড রাসেল তখন বিশ্বের আইকন। কারণ কিউবা সঙ্কট নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকার মাঝে যুদ্ধ ছিল প্রায় আসন্ন। তখন বার্ট্রান্ড রাসেল শান্তির পতাকা হাতে এগিয়ে যান এবং বিশ্বকে রক্ষা করেন ভয়াবহ এক পারমাণবিক যুদ্ধের কবল থেকে। বাঙালীর পারিবারিক সংস্কৃতি অনুযায়ী পরিবারের ছোটজন সর্বোচ্চ আদর এবং শাসন দুটোই ভোগ করেন। সে অনুযায়ী রাসেল ছিল সবার প্রিয়। অনেক ক্ষেত্রে বড় বোন শেখ হাসিনাই ছিল সহায় এবং খেলার বড় সাথী। যেমন শেখ হাসিনার বেণী ছিল তার খেলার অন্যতম বিষয়বস্তু। তাছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে কিছু ব্যতিক্রম গুণাবলীও ছিল তার মাঝে। এসব ছাপিয়েও ছিল তার কুকুরের সঙ্গে খেলাধুলা এবং খুনসুটি। বাসায় থাকা টমিকে ভীষণ আদর করতেন। নিজের প্রায় সব খাবারের কিছু না কিছু অংশ যেত টমির পেটে। কিন্তু একদিন টমি হঠাৎ বিরক্তি নিয়ে ঘেউ ঘেউ করায় ঘটে বিপত্তি। সোজা গিয়ে বোন রেহানাকে নালিশ ঠুকে দেয়। কিন্তু সেখানে থাকা বাকিরা নালিশ শুনে হাসতে শুরু করায় রাসেল মন খারাপ করে বসে। তবে এই যে খেলার সঙ্গীহীনতা তা শেখ রাসেলকে বেশি পোহাতে হয়নি। কারণ কিছুদিনেই জন্ম নেয় বঙ্গবন্ধুর নাতি। রংপুরে জন্ম নেয়া বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জয়ের এই জন্মে রাসেল ছিল আত্মহারা। কারণ সজীব ওয়াজেদ জয় হয়ে উঠেছিল তার শেখার, শেখানোর এবং খেলাধুলার আনন্দ সঙ্গী। আবার ওই শিশু বয়সেই জয়ের প্রতি দায়িত্ববোধ ছিল প্রবল। যুদ্ধের সময়টায় জয়ের জন্ম, তাই গোলাবারুদসহ শব্দ সমস্যায় প্রায়ই জয়ের ঘুমের অসুবিধা হতো। এই বিষয়টাকে মোকাবেলা করার জন্য রাসেলের চেষ্টার অন্ত ছিল না। রাসেল যত বেড়ে উঠতে শুরু করে তত তার ডানপিটে স্বভাবের বহির্প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। এর মধ্যে স্কুলে যাওয়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিন চলত তার নানা খেলা। অগত্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি করানো হলেও একজন শিক্ষিকাকে বাসায় রাখতে হয় পড়াশোনা দেখানোর জন্য। তবে ঢাকায় যেমন তেমন টুঙ্গিপাড়ায় গেলে তাঁর খেলাধুলার পরিধি এবং ধরন বদলে যেত। সেনা অফিসার হতে চাওয়া রাসেল তাঁর বন্ধুদের একত্রে করে নানান উপাদান দিয়ে বন্দুক বানাত এবং খেলত। তবে রাসেলের এই খেলোয়াড় বাহিনীর জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিতে হতো ভিন্ন দায়িত্ব। আর তা হলো টুঙ্গিপাড়ায় গেলে তার খেলার সাথীদের জন্য নিতে হতো নতুন জামা-কাপড়। জন্মলগ্ন থেকে রাসেল যেমন বাবার সংস্পর্শ পায়নি, তেমনি বাবা হিসেবে বঙ্গবন্ধুও তার আদরের রাসেলকে কাছে পাননি। পিতা-পুত্রের এই তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ হয় বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সুযোগ পেলেই রাসেলকে সফরসঙ্গী করতেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সহায়তাকারী জাপান যুদ্ধ পরবর্তী দেশ পুনর্গঠনে সহায়তার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে’ আমন্ত্রণ জানায় এবং দেখা যায় বঙ্গবন্ধু সেই সময়টায় রাসেলকে সঙ্গে নেন। বঙ্গবন্ধু এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাদের ছোট্ট রাসেলের পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও ছিলেন ওয়াকিবহাল। সফরে গেলে ছেলেকে পরাতেন প্রিন্স কোট। তবে তাদের এই সুযোগ হয়ে ওঠেনি খুব বেশিদিন। যদিও ঘাতকের বুলেট থেকে রাসেল বেঁচে যেতে পারতেন! কারণ তার বোন জামাই পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া এবং বোন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তারও জার্মানি যাবার কথা ছিল। জন্ডিস হওয়ায় যাওয়া হয়নি। জাগতিক এই জীবনকালে মৃত্যুই প্রকৃত বাস্তবতা। তবে একে আলিঙ্গনেও চাই যথার্থ সময় এবং পদচিহ্ন রেখে যাবার সুযোগ। তাছাড়া স্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যেকের অধিকার। সেখানে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও ছোট্ট রাসেলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এই দায় শুধু হত্যাকারীর নয়, বরং তৎকালীন সময়ের নীরব ভূমিকা পালনকারীদেরও। তবু এত বেদনা বুকে নিয়েও, বেদনার শতদল মাড়িয়েও আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি ইতিহাসের নারকীয় হত্যার ন্যায় বিচার এবং অকালে ঘুমিয়ে যাওয়া প্রাণগুলোতে গভীর হাহাকার। লেখক : ছাত্রনেতা [email protected]
×