ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ড্রোনের পর এবার স্যাটেলাইটে মশা নিধন

প্রকাশিত: ১১:২৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

ড্রোনের পর এবার স্যাটেলাইটে মশা নিধন

কাওসার রহমান ॥ ‘ডেঙ্গু’ এখন আর ঢাকার চিন্তার ভাঁজ নয়; ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ জার্সি বা সান ফ্রান্সিসকোকেও একইভাবে ভাবাচ্ছে ক্ষুদ্র পতঙ্গবাহী এই রোগ। মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েক মাস আগেই আমেরিকার বড় শহরে ড্রোন নামিয়েছিল গুগল। এবার আরও একধাপ এগিয়ে মশা দমনের ভার নিল খোদ নাসা। নাসার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার ল্যাবরেটরি। এদের হাতিয়ারটি ড্রোনের চেয়েও শক্তিধর। সোজা কথায় বললে মশা মারতে কামান নয়, রীতিমতো স্যাটেলাইট দেগেছে নাসা। তবে এর পাশাপাশি ছোট ছোট অজস্র দলও তৈরি করেছে তারা। থাকছে এয়ার ট্র্যাপিংয়ের ব্যবস্থাও। যে ব্যবস্থা সবচেয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। স্যাটেলাইট ছাড়াও সেই দলের কাছে মজুদ থাকবে ক্যামেরা, গ্রাফ, ম্যাপিংয়ের ব্যবস্থা, তথ্য যাচাই ও জমা করার জন্য নানা ধরনের চিপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দাবি, আমেরিকা তো বটেই, বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশই মশার আতঙ্ক বুকে নিয়েই বাঁচছে। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩০-৫০ কোটি মানুষ মশাবাহিত রোগের শিকার হন। মৃত্যু হয় প্রায় ১ কোটি মানুষের। কোন কোন ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের সময়টুকুও পাওয়া যায় না। ইদানীং সে সমস্যা আরও বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ বিস্তার যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে তাতে বিজ্ঞানীদের আর কোন সন্দেহ নেই। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশেও ডেঙ্গুর ঝুঁকির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে চলতি ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ অনেকটা মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করেছে। বিখ্যাত জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর ঝুঁকি ৩৯ শতাংশ কমেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গুর ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর ঝুঁকি ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে এজন্য অব্যাহত মশক সন্ত্রাস থামাতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু মশা মারতে এমন কামান, স্যাটেলাইট দাগতে হলো কেন নাসাকে? এ প্রসঙ্গে ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশনের’ (সিডিসি) তথ্য অনুয়ায়ী, গত কয়েক দশক ধরেই মশার হানায় ব্যতিব্যস্ত ইংল্যান্ড-আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিশেষ করে গরমের সময় এই মশার উৎপাত বাড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোসহ আমেরিকার কিছু বড় শহর মশার জ্বালায় নাজেহাল। কয়েক দশক ধরেই মশার অত্যাচার ক্রমেই বাড়ছে আমেরিকা জুড়ে। ২০০৪ সালে মশার প্রাদুর্ভাব যতটা ছিল, ২০১৬-য় পৌঁছে সেই প্রভাব বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। নাসার এই কাজটি প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে শুরু হয় বছর পাঁচেক আগেই। আসে বিপুল সাফল্য। সেই সফলতাই এবার এই প্রোজেক্টকে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে দেয়ার সাহস জোগায় নাসাকে। যা এতকাল ক্যালসার্ব (ক্যালিফোর্নিয়া ভেক্টরবর্ন ডিজিজ সার্ভিলেন্স) ছিল তা এবার ভেক্টরসার্ব হয়ে উঠবে। অর্থাৎ ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়াও গোটা আমেরিকায় যেখানে যেখানে মশা রয়েছে সেখানেই তল্লাশি চালাবে। মশাদের এই বাড়বাড়ন্ত কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়টি ভাবনায় রেখেছে আমেরিকাকে। গোটা বিশ্বেই মশারা দিনের পর দিন জিনগত মিউটেশনের ফলে মশা মারার বিভিন্ন পদ্ধতি ও রাসায়নিকের সঙ্গে অভিযোজিত হতে শিখে যাচ্ছে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করেন মশাবাহিত অসুখের বিশেষজ্ঞরা। কিভাবে স্যাটেলাইট মশা খুঁজবে? আসলে স্যাটেলাইটটি লক্ষ্য রাখবে কোথায় মশা জন্মানোর পরিবেশ-পরিস্থিতি রয়েছে। সেই তথ্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চলে যাবে টিমের কাছে। দলে থাকছেন বিভিন্ন পতঙ্গবিদ, বিজ্ঞানী, পতঙ্গবিদ্যার অধ্যাপকসহ অনেকেই। তারা অকুস্থলে পৌঁছে মশার ডিম পাড়ার খবর, লার্ভা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা, মশার শরীরে কতটা জীবাণু, আদৌ কোন রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা তাদের আছে কিনা, পুরো বিষয়টাই খতিয়ে দেখবে। তৈরি করবে জায়গাটির মানচিত্র, তুলে রাখবে ছবিও। যার সাহায্যে বোঝা যাবে ওই মশা কতটুকু ছড়িয়ে যেতে পারে, জায়গার অবস্থানইবা কী। পরীক্ষার বিষয়টিতে সাহায্য করবে বিভিন্ন সংস্থার ল্যাবরেটরি। এবার সেসব তথ্য ও পরীক্ষার ফল জমা হবে দলের কাছে থাকা চিপে। সেই ডেটাবেজই ছড়িয়ে দেয়া হবে নাসার বিশেষ ওয়েবসাইটে। সেই ওয়েবসাইট নিয়মিত দেখে মশা দমনের পদক্ষেপ নেবে সরকারী দফতরগুলো। থাকবে এয়ার ট্র্যাপিংয়ের ব্যবস্থাও। মশারা কোন রাজনৈতিক ব্যবধান মানে না। জানে না কোন্ দেশের আকাশ কার। তাই ডানায় ভর করে সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যেতে পারে। প্রজাতি অনুসারে মশাদের আবার ওড়ার ক্ষমতাও পৃথক হয়। কেউ হাওয়ার সাহায্যে বেশি দূর ওড়ে, কেউ আবার নিজেরাই অনেকদূর উড়তে পারে। এয়ার ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা মশাদের গতিবিধি ও হাওয়ার গতি কোন্ অভিমুখে সেই দিকটাও খতিয়ে দেখা যাবে। তবে ফল পেতে গেলে এই পদ্ধতি প্রতিদিন ধৈর্য ধরে পালন করতে হবে। বেশ ব্যয়সাপেক্ষ এমন উপায় চালিয়ে যেতে না পারলে খুব একটা লাভ নেই। ঠিক যে কারণে ভারতেও সত্তর-আশির দশকে ইসরো-র সাহায্যে জিপিএস ম্যাপিং করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মসকিউটোজেনিক কন্ডিশন (কোথায় কোথায় মশার ডিম পাড়ার জন্য অনুকূল অবস্থা তা জানা) খতিয়ে দেখার কাজ সফল হয়নি। এই পদ্ধতিতে এক দিনেই কাক্সিক্ষত ফল মিলবে না। দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে জমা হবে তথ্য। বিভিন্ন পরীক্ষা, ব্যর্থতা, সাফল্য সব নিয়েই এগোবে প্রোজেক্ট। খুব ব্যয়সাধ্য ও বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের অভাবেই ভারতে এই ধরনের প্রোজেক্ট বেশিদিন চলেনি। তবে ঠিকমতো কাজ করলে ও খরচ জোগাতে পারলে এভাবে মশার উৎপাত অনেকটা কমিয়ে দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ইউনিটের সমন্বয়কারী ইকবাল কবীর। তিনি বলেন, নাসা যেভাবে কোমর বেঁধে মশা মারতে নেমেছে তার সুফল মিলবে হাতেনাতে। মশার লার্ভা পাওয়ার পরেই শুরু হবে আসল কাজ। সেসব পরীক্ষা করে তাতে অসুখের জীবাণু পেলে এক রকম, না পেলে ওই স্থানের অন্যান্য মশার লার্ভা নিয়ে ফের পরীক্ষা, রীতিমতো সময়সাধ্যও ব্যয়সাধ্য। তবে এই পদ্ধতিই সবচেয়ে আধুনিক। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ সম্ভব কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তবে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। স্পার্সোর মাধ্যমে ওয়াটার লগিংয়ের চিত্র নিতে হবে। তারপরও ওইসব এলাকায় গিয়ে সার্ভে করে মশার লার্ভাও অন্যান্য স্যাম্পল সংগ্রহ করে তা এনালাইসিস করতে হবে। এর সঙ্গে স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশন এবং ডিজি হেলথকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে। এটি হচ্ছে মূলত অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে। ফলে মশা ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাই আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সব ধরনের মশাই মারতে হবে। ২০১৯ সালে এসে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ বিস্তার লাভ করে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ নবেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯৮ হাজার ৫০০ জন। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৫০ হাজার ৪২২ এবং ঢাকার বাইরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৮ হাজার ৭৮ জন। একই সময়ে ছাড়পত্রপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৯৭ হাজার ৬২৬ জন। তার মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ৪৯ হাজার ৯৫৩ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৪৭ হাজার ৬৭৩ জন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ২৫১ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রেরণ করা হয়। তাদের মধ্যে আইইডিসিআর ১৭৯ জনের মৃত্যু পর্যালোচনা করে ১১২ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। গত ১৪ নবেম্বর সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারাদেশে ৯৭ নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৩৪ ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৬৩ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালের মোট ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৬২৩ জন। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৭৬ এবং ঢাকার বাইরে ৩৪৭ জন ভর্তি রয়েছেন। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও প্রতিবেশী শহর কলকাতা এখন ডেঙ্গুর নতুন হুমকিতে পড়েছে। শুক্রবারও কলতাকার পুরো অধিবেশন ডেঙ্গু নিয়ে উত্তাল হয়েছে। এই অবস্থায় নাসা-র এমন পদ্ধতি মনে আশার আলো দেখালেও খরচ ও সমন্বয় সবটা মেনে এমন পদ্ধতির শরণ নেয়া যায় কিনা তা ভাবাচ্ছে ঢাকা ও কলকাতার তামাম পতঙ্গবিদ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে।
×