ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লোকায়ত জীবনের কাছে ঋণ স্বীকার, শোধ করার নাগরিক চেষ্টা

প্রকাশিত: ১১:২৪, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

লোকায়ত জীবনের কাছে ঋণ স্বীকার, শোধ করার নাগরিক চেষ্টা

মোরসালিন মিজান ॥ চারুকলার বকুলতলায় পা রাখতেই চমৎকার একটা অনুভূতি হলো। সেই ফেলে আসা গ্রাম, লোকায়ত জীবনের ছবি! তরুণীদের কেউ কেউ গৃহস্থ বাড়ির বউটির মতো সেজে এসেছিলেন। কারও ফিতেয় বাঁধা চুল। কেউ সুন্দর বেনুনী করেছেন। তরুণরা ধারণা করেছিলেন কৃষকের সাজ। মঞ্চে লোকগান লোকনৃত্য কবিতা হচ্ছিল। সব দেখে মনে হয়েছে, গ্রামের অযুত ঋণ শিকার করে নিচ্ছে রাজধানী শহর। এ ঋণ, না, শোধ করার নয় কোনদিন। এর পরও সচেতন নাগরিকদের আন্তরিক চেষ্টা। গাঁয়ের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে আসা মানুষ সারাদিনই বাঙ্গালী কৃষ্টির জয়গান করেছেন। শেকড়ের কাছে ফেরার তাগিদ দিয়েছেন তারা। পুঁজির প্রলোভন আর কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসন রুখার শপথ নিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সবই হলো নবান্ন উৎসবে। শনিবার ছিল ১ অগ্রহায়ণ। হেমন্তের দ্বিতীয় মাসের প্রথমদিন সারাদেশে উদ্যাপিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। বরাবরের মতোই বর্ণাঢ্য ছিল ঢাকার আয়োজনটি। ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রধান উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন। বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতো। এছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো। শাক ভর্তা ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোন কোন বাড়িতে। তবে বর্তমানের ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখন প্রায় সারাবছরই কোন না কোন ধান হয়। কৃষি ছাড়াও আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুযোগ বেড়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। শুধু ধানের জমির দিকে তাকিয়ে আর থাকছেন না কৃষকরা। ফলে নবান্ন উৎসবের দিন আগের মতো অতো আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়ে না। শহরও মোটামুটি ভুলে থাকে দিনটিকে। তবে শেকড় সন্ধানী মানুষেরা, সংস্কৃতিপ্রেমীরা চিরায়ত ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিবছর নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। এবারও তাই হয়েছে। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বর্ণাঢ্য নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালী চেতনার উৎসবে যোগ দেন। নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায় নতুন প্রজন্ম। যন্ত্রসঙ্গীতের মধ্যদিয়ে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে সূচনা হয় নবান্ন উৎসবের। এরপর একটানা চলে গান নাচ আবৃত্তি। একক ও দলীয় পরিবেশনায় গ্রামীণ জীবন ও লোকাচার তুলে ধরা হয়। কয়েকশ শিল্পী ও সংগঠনের পরিবেশনায় বকুলতলা হয়ে ওঠে এক খ- গ্রাম। ছিল আলোচনাও। ছোট্ট এ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বরেণ্য নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার। উৎসব পর্ষদের চেয়ারপার্সন প্রবীণ নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন, যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম হাসান সুজা। সকাল সাড়ে ৯টায় বকুলতলা থেকে নবান্ন শোভাযাত্রা বের করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে শোভাযাত্রা আবার অনুষ্ঠানস্থলে ফিরে আসে। বিকেলে আরও বেশি মুখরিত ছিল উৎসব প্রাঙ্গণ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, আমাদের প্রতিদিনের জীবন এখন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। অথচ এখানে এসে দেখছি সুন্দর একটি পরিবেশ। কী সুন্দর গান হচ্ছে! নাচ হচ্ছে। এগুলোর খুব দরকার। গ্রামীণ ঐতিহ্যের উৎসবগুলো অন্তর দিয়ে উদ্যাপন করা উচিত বলে মত দেন তিনি। নিজের পরিচয় ভুলে থাকা নাগরিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শহুরে জীবনে বৈচিত্র যোগ হবে। তা হতেই পারে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে আত্মপরিচয় ভুলে গেলে চলবে না। গ্রামীণ ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখে নাগরিক জীবনে পরিবর্তন আনতে হবে। উৎসবে যোগ দেন দেশের আরেক বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, আমাদের যে পেছনের ঐতিহ্য, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য, হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি, সেখানে আবার আমরা অবগাহন করতে চাই। আমাদের অনেক ঋণ গ্রামের কাছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি আমাদের দিয়ে যাচ্ছে শুধু। নবান্ন উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে আমরা নাগরিকরা কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হতে চাই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই। অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজ আমাদের দেশের জন্য মানবিক চেতনা খুব জরুরী। এসব উৎসবে মানুষকে যত বেশি যুক্ত করা যাবে ততই তারা মানবতাবাদী হয়ে ওঠবেন। তবেই সার্থক হবে উৎসব। আয়োজকদের পক্ষে জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদের চেয়ারম্যান লায়লা হাসান বলেন, আজকের প্রজন্ম শেকড়ের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ধাবিত হচ্ছে। নবান্ন উৎসবের মতো আয়োজনগুলো থেকে আমরা তাদের পথ দেখাতে পারি। তাদের মনে যদি দেশপ্রেমের বীজ বপন করে দিতে পারি, তবে নিশ্চয়ই তারা বাংলাকে ভালবাসবে।
×