ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

অনন্য মানুষ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

 অনন্য মানুষ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

গতকাল ছিল রণদা প্রসাদ সাহার ১২৩তম জন্মজয়ন্তী। একজন রণদা প্রসাদ সাহা বা সংক্ষেপে আর পি সাহার জীবন আগামী প্রজন্মের জন্য অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কারণ এমন জীবনের কথা আমার জীবনে আর একটিও শুনিনি বা কোথাও পঠ করিনি। ‘দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ইংরেজী ১৮৯৬ সালের ১৫ নবেম্বর সাভারের অদূরে শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামের মাতুলালয়ে। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার, মাতা কুমুদিনী দেবী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ দ্বিতীয়। রণদা প্রসাদ সাহার পৈতৃক নিবাস বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলা সদরে। রণদা প্রসাদ সাহা ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত চালাক-চতুর, হাসিখুশি ও দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত মির্জাপুর বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তাঁর বয়স যখন সাত বছর, তখন দারিদ্র্য আর অবহেলায় চোখের সামনে মায়ের অসহায় মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। এই মৃত্যুই তাঁর জীবনে চরম প্রভাব ফেলে। হয়ত তখনই মনের মধ্যে দানা বাঁধে মানুষের জন্য, মানবতার জন্য একটা কিছু করতে হবে। সন্তানদের লালন পালনের জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথ আত্মীয়-পরিজনের পরামর্শে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। সৎ মায়ের আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট ও অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে রণদার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়। শৈশব থেকে মানব কল্যাণের যে স্বপ্ন নিজের মনে লালন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৩৮ সালে মাতামহীর নামে শোভা সুন্দরী ডিস্পেন্সারি ও মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আড়াই শতাধিক লঙ্গরখান পরিচালনা করেন তিনি। রণদা প্রসাদের আহ্বানে ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার গবর্নর লর্ড আর জি কেসি কলকাতা থেকে নদীপথে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এক অজো পাড়াগাঁয়ে এসে কুমুদিনী হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সঙ্কটময় সময়ে রণদা রেডক্রসকে আড়াই লাখ রূপী দান করেন। ওই টাকায় সে সময়ে ঢাকা শহরের একটি বিশাল অংশ কিনে ফেলা যেতে পারত। অবহেলিত নারী সমাজকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে ও স্বাবলম্বনে ১৯৪০ সালে তাঁর প্র-পিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন নারী শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান ভারতেশ্বরী হোমস্। শৃঙ্খলা ও নিয়ামানুবর্তিতার জন্য ভারতেশ্বরী হোমসের নাম দেশজুড়ে সুবিদিত। পূর্ববাংলার প্রথম মহিলা ডিগ্রী কলেজ কুমুদিনী মহিলা কলেজ, মানিকগঞ্জে পিতার নামে দেবেন্দ্র কলেজ, মির্জাপুর কলেজ, মির্জাপুর এস কে হাইস্কুল ভবন নির্মাণ, মাগুরার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রতিষ্ঠায় মোটা অঙ্কের আর্থিক অনুদান, ঢকার কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল (সিএমএইচ)-এর প্রসূতি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। এছাড়া আরও নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভারত বর্ষের কলকাতা, দার্জিলিং, ঝাড়খ-, বর্তমান পাকিস্তানের হরিপুর ডিস্ট্রিক্ট, সমগ্র পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের নানা স্থানে রণদা প্রসাদ সাহা বিভিন্ন জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সহায়তা করেন। ১৯৪৭ সালে যে সময়টিতে শুধু ধর্মের কারণে অসংখ্য মানুষ এই অঞ্চল থেকে স্রোতের মতো দেশান্তরী হয়ে পশ্চিম বাংলায় যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় কলকাতার ব্যবসা বাণিজ্যের পাঠ চুকিয়ে সেখানকার অঢেল সম্পদের মায়া ত্যাগ করে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রণদা নিজ মাতৃভূমিতে পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন। রণদা প্রসাদ সাহা শৈশবে মানবকল্যাণের যে দীক্ষা নিয়েছিলেন সেই আদর্শ বাস্তবায়ন ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে তাঁর সমুদয় সম্পত্তি এই ট্রাস্টের অধীনে লিখে দেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলো এই ট্রাস্টের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- কুমুদিনী হাসপাতাল (মির্জাপুর), কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউিট, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ, ভারতেশ্বরী হোমস, ট্রেড টেনিং স্কুল, কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাপটস, কুমুদিনী ফার্মাসিউটিক্যালস, আরপি সাহা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি। প্রতিষ্ঠানগুলো টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এই অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত এই ট্রাস্ট মানবতার সেবায় অনন্য অবদার রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়। মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রণদা প্রসাদ সাহাকে রায় বাহাদুর খেতাব প্রদান করে। পূর্ববাংলার প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেতাব হেলাল-ই-পাকিস্তান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ও তাঁর কাজের যথাযথ স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে রণদা প্রসাদ সাহার শুভাকাক্সক্ষীরা দেশত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে এই অকুতভয় মানুষটি কোথাও যেতে রাজি হননি। ১৯৭১ সালের ৭ মে আমাদের এদেশীয় রাজাকারদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানী বাহিনী রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর ২৬ বছর বয়সী সন্তান ভবানী প্রসাদ সাহা (রবি)-কে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁরা আর কখনও ফির আসেননি। মিশে গেছেন এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে। তাঁদের রক্তে আমরা পেয়েছি আজকের বাংলাদেশ। লেখক : গণমাধ্যম কর্মী
×