ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়ায় কিশোরী ক্লাবের সাফল্য

নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সচেতনতা বাড়ছে

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

  নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ ঠেকাতে  সচেতনতা বাড়ছে

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ বগুড়ার কিশোরীরা নারীর প্রতি সহিংসতা এবং বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সচেতন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারের কিশোরী ক্লাবের মাধ্যমে এই সচেতনতা গড়ে তোলা হচ্ছে। মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের পরিচালনা ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহযোগিতায় এই কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, আগামী বছর থেকে কর্মসূচী আরও সম্প্রসারিত করে কিশোর-কিশোরী ক্লাব বা কিশোর-কিশোরী রিসোর্স সেন্টারে রূপান্তরিত হবে। বগুড়ার ১২ উপজেলার ৫০ ইউনিয়ন পরিষদে এক্সিলারেটিং এ্যাকশন টু ইন চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ কর্মসূচীর আওতায় ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের সচেতন করে তোলা হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়নে জেন্ডার প্রমোটারগণ সপ্তাহের ছুটির দিনে (শুক্রবার) গ্রামের কিশোরীদের সুবিধামতো সময়ে কোন স্কুলঘরে বসে দুই ঘণ্টা করে সচেতনতার পাঠদান করেন। এই বিষয়ে ইউএনএফপিএ বগুড়ার ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর মাসুদা ইসলাম জানান, মাঠ পর্যায়ে ইউএনএফপিএর দুজন প্রতিনিধি জাওয়াদ হাবিব ও তানজিনা আক্তার বিষয়গুলো মনিটরিং করেন। কিশোরীদের প্রথমে শেখানো হয় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে। প্রতিটি গ্রুপে ৩০ জন করে সদস্যের মোট দুটি গ্রুপে ৬০ কিশোরী থাকে। তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ইউএনএফপিএর তৈরি কিশোরীদের সাহানা কার্টুন বানানো হয়েছে। এই কার্টুনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিশোরীদের জীবনপ্রবাহ গড়ে তোলার সকল বিষয় খুব সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। কিশোরীরা কার্টুনটি দেখে সহজেই বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে পারে। পরে প্রতিটি বিষয়ের ওপর কিশোরীদের সঙ্গে সহজভাবে আলোকপাত করেন মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের নিয়োজিত জেন্ডার প্রমোটাররা। বগুড়া সদর উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেন্ডার প্রমোটার ইশরাত জাহান বললেন, গ্রামের কিশোরীরা সাধারণত শিশুবেলায় গৃহস্থালি কাজে নিজেদের কর্মদক্ষ করে তোলার দীক্ষা পায় মায়ের কাছে থেকে। তারা সহজেই সাহানা কার্টুনের বিষয়গুলো আয়ত্তে আনতে পারে। শেরপুর উপজেলার জেন্ডার প্রমোটার মাকসুদা বেগম বললেন, আগে কিশোরীরা মেয়েদের পিরিয়ড, বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে কথা বলতে (বিশেষ করে বিয়ের পরবর্তী বিষয়) লজ্জা পেত। সচেতনতা কর্মসূচীর পর তারা নিজেদের সহজ করে নিতে পারছে। তারা এখন মেয়েদের বয়োসন্ধিকাল ও কৈশোরকাল কি তা বুঝতে পারে। এ সময় বিয়ে ও গর্ভধারণ হলে শরীরের ওপর কতটা ধকল ও অপুষ্টিজনিত কত রোগব্যাধি হতে পারে তা জানে। কিশোরীরা এখন সরাসরি বলতে শিখেছে ১২-১৪ বছর বয়সে পিরিয়ড শুরু হলেও তা সন্তান ধারণ ও জন্মদানের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয় না। এই সময়ে জোর করে সন্তান ধারণ ও সন্তান জন্মদান করলে মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি থাকে। বেঁচে গেলেও অপুষ্ট ও রুগ্ন শিশু জন্ম নেয়। সেই শিশুকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারছে ১৮ বছরের পর বিয়ে হলেও ২০ বছরে সন্তান নিতে হয়। এতকাল কথাগুলো গ্রামের মেয়েরা সহজে বলতে পারত না। এখন তারা বুঝতে ও বলতে পারছে। একজন বিষয়গুলো জেনে তার সহপাঠী ও পরিচিতজনকে বলতে পারছে। বালিকা বধূ হওয়ার পর স্বামীর একাধিক বিয়ের প্রবণতা, দাম্পত্য কলহ ও বিচ্ছেদ বেড়ে যায়। এ থেকে সৃষ্ট পরিণতিতে শারীরিক নির্যাতনের পর আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়গুলো কিশোরীরা জানার পর তাদের এলাকায় এ ধরনের ঘটনায় নিজেরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে। এতকাল মেয়েশিশু ও কিশোরীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিল না। এখন তারা সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি বুঝতে পারে। কিশোরীরা বিয়ে পড়ানোর সময় কাজীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেনÑবাল্যবিয়ে পড়ালে ও রেজিস্ট্রি করলে প্রশাসনকে জানিয়ে দেবে। এ কারণে অনেক কাজী আগেভাগেই জেনে নেন কনের বিয়ের বয়স এবং দেখতে চান বয়সের প্রমাণ। কিশোরীরা এখন সংঘবদ্ধ। যাদের অনেকে মেন্টর হিসেবে কাজ করতে শিখেছে। কখনও নিজেরাই কিশোরীদের সঙ্গে নিয়ে বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেয়। তারা কোথাও নারীর প্রতি কোন ধরনের নির্যাতন, সহিংসতা, বাল্যবিয়ে দেখলে এবং খবর পেলে টোল বিহীন ফোন নম্বরে বিষয় জানিয়ে দেয় উপর মহলে। দ্রুত জনপ্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিষয়টি অবহিত করে।
×