ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নবান্ন উৎসব আজ ॥ রাজধানীতে বর্ণাঢ্য আয়োজন

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

 নবান্ন উৎসব আজ ॥ রাজধানীতে বর্ণাঢ্য আয়োজন

মোরসালিন মিজান ॥ মা মাগো এসেছি আমি! সেই কবে গভীর নিশীথে/তোমার নিমাইপুত্র ঘর ছেড়েছিল, আজ কাশী বৃন্দাবন/তুলাধুনা করে ফের তোর দীর্ণ চৌকাঠে এসেছি...। মায়ের কাছে, ভুলে থাকা গ্রামের কাছে ফেরার দিন এসেছে। হাসি আনন্দে মাতার নবান্ন উৎসব আজ। আজ শনিবার ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। প্রতি বছর এই দিনে উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রধান উৎসবে এবারও মাতবে গ্রাম-বাংলা। নতুন চালে হবে নবান্ন। ঘরে ঘরে চলবে পিঠাপুলির আয়োজন। বাদ যাবে না রাজধানী শহরও। ঢাকার চারুকলার বকুলতলায় দিনভর চলবে নবান্ন উৎসব। শহুরে প্রলোভন কর্পোরেট সংস্কৃতি আর নিজেকে ভুলে থাকার এই সময়ে আলাদা তাৎপর্যের হয়ে উঠেছে নবান্ন উৎসব। গ্রামের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে আসা বাঙালী স্মৃতিতে হলেও গ্রামে ফিরে যাবে। শহর, গ্রাম সর্বত্রই লাগবে হাসিরাশি আনন্দের ঢেউ। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্যাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন। বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতে। এ ছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো। শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোন কোন বাড়িতে। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ করা হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করেন। পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। কে চায় অমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। অতীতে পৌষসংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। কাকবলীর আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ ও বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা মূলত বরিশাল অঞ্চলের। এর নিয়মানুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলী, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না। তবে বর্তমানের ছবিটা একটু আলাদা। এখন প্রায় সারা বছরই কোন না কোন ধান হয়। সনাতন মাড়াই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। যন্ত্রযুগে প্রবেশ করেছে গ্রাম। কৃষি ছাড়াও আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুযোগ বেড়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। অল্পে বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই ধানের জমির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হয় না। আর নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। নেই বললেই চলে। রাজধানী শহর ঢাকায় বসে শুধু অনুভব করা যায়। শিকড়সন্ধানী মানুষ চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। ঘরে ঘরে উৎসব আয়োজনের সুযোগ নেই। তাই বলে খিল এঁটে কেউ ঘরে বসে থাকবেনÑ এমন নয় বরং শহওে, নগরে ভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপিত হয় নবান্ন উৎসব। আজ মনের আনন্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন শিকড়সন্ধানী মানুষ। শহরজুড়ে থাকবে হরেক আনুষ্ঠানিকতা। বর্ণাঢ্য আয়োজন চারুকলার বকুলতলায় প্রতি বছরের মতো আজ চারুকলার বকুলতলায় বর্ণাঢ্য নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দেবেন সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ। নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবে নতুন প্রজন্ম। খুব সকালে নবান্ন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যন্ত্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে উৎসব শুরু হবে। নবান্ন কথন পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বরেণ্য নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার। উৎসব পর্ষদের চেয়ারপার্সন বরেণ্য নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম হাসান সুজা। সকাল সাড়ে ৯টায় বকুলতলা থেকে নবান্ন শোভাযাত্রা বের করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে শোভাযাত্রা আবার অনুষ্ঠানস্থলে ফিরে আসবে। লোক সংস্কৃতির মহোৎসবে যোগ দিন। বাঙালিত্বের গৌরব নিয়ে বাঁচুন।
×