ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনলাইনে উগ্রপন্থা চর্চা বেড়েছে

ইন্টারনেট ব্যবহারেই জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে ৮২ ভাগ তরুণ

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

 ইন্টারনেট ব্যবহারেই জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ  হচ্ছে ৮২ ভাগ তরুণ

শংকর কুমার দে ॥ দেশের শতকরা ৮২ ভাগ তরুণ-যুবক ইন্টারনেট ব্যবহার করেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে জঙ্গীবাদে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার হওয়া ৭শ’ জঙ্গীর ওপর জরিপ চালানো এই পরিসংখ্যানের তথ্য পেয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইন্টারনেটভিত্তিক জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ৮২ ভাগ তরুণ-যুবক। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক পুলিশ সম্মেলনে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে জঙ্গীরা অনলাইনে উগ্রপন্থা চর্চা ও জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। জঙ্গী বিরোধী অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অনলাইনে নানা ধরনের প্রচার। ইন্টারনেটে নানা নামে ওয়েবসাইট-ব্লগ খুলে জঙ্গীবাদের প্রচার চলছে। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ এবং ইউটিউবে ভিন্ন ভিন্ন নামে চ্যানেল খুলেও এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জঙ্গীদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে যেসব কনটেন্ট রয়েছে তার বেশিরভাগ সরাসরি জঙ্গী কার্যক্রমকে উসকে দিচ্ছে। এভাবে অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে উগ্রপন্থা চর্চা এবং জঙ্গীবাদে ধাবিত করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যানুযায়ী, দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে অনলাইনে জঙ্গীবাদ উসকে দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন বিদেশী থেকেও জঙ্গীবাদের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলে তথ্যাদি পেয়ে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গীবাদ দমনে পরামর্শ করতে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ও বাংলাদেশ পুলিশ আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে। সেই সম্মেলনে পুলিশের ডাকে সাড়া দিয়েছে ফেসবুকও। ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইনে জঙ্গী তৎপরতা দমনে ফেসবুকের সাহায্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ পুলিশের জরিপ চালানো পরিসংখ্যান তুলে ধরেন সম্মেলনে। তিনি বলেন, ৭শ’ জঙ্গীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে ৮২ ভাগ তরুণ নিজেরাই নিজেদের উদ্বুদ্ধ করেছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এ সমস্যা সমাধানে ফেসবুকের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। দুই বছর আগে ২০১৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত এ সম্মেলনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোসহ মোট ১৪ দেশের পুলিশ প্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। এতে অংশ নেন পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), অস্ট্রেলিয়ার অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ (এএফপি) সহ আসিয়ান পোল, অপরাধ তদন্ত নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারপোল গ্লোবাল কমপ্লেক্স ফর ইনোভেশন (আইজিসিআই), ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং এ্যাসিসটেন্স প্রোগ্রাম কর্মকর্তারা। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাবের হাতে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় সম্প্রতি গ্রেফতার হয় মোঃ নুরুজ্জামান ও নাজমুল ইসলাম শাওন নামের দুই জেএমবির জঙ্গী। গ্রেফতারের পর তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রায় ৪০-৫০ জন সমমনা উগ্রবাদীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে জঙ্গী তৈরি করেছে তারা। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক ক্রমশ দুর্বল ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গীরা পুনরায় একত্রিত হয়ে নেটওয়ার্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমমনাদের একত্রিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে র‌্যাব তাদের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের এর একটি আভিযানিক দল অভিযান পরিচালনা করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার সোনালী ব্যাংক মোড় থেকে জেএমবি সদস্য মোঃ নুরুজ্জামান লাবু ও নাজমুল ইসলাম শাওনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গীদের যোগাযোগের বিষয়টি প্রকাশ পায়। র‌্যাব সত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গীরা পুনরায় একত্রিত হয়ে নেটওয়ার্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমমনাদের একত্রিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া জেএমবি সদস্য মোঃ নুরুজ্জামান লাবু ও নাজুমল ইসলাম শাওনের কাছ থেকে ২টি চাপাতি, জঙ্গীবাদী বই, ৭২৪ ইউএস ডলার এবং অন্যন্যা সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, তারা জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সক্রিয় সদস্য হয়ে কাজ করছে। জিজ্ঞাসাবাদে নুরুজ্জামান জানায় যে, সে প্রথম জীবনে বাসের হেলপার, ট্রাকের হেলপার, লন্ডি দোকানে কাজ করত। বর্তমানে সে একজন দিনমজুর ও রিক্সাচালক হিসেবে জীবনযাপন করছে। সে ২/৩ মাসের জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও পড়ালেখা শেষ করা সম্ভব হয়নি। সে ইতোপূর্বে জামায়াত ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এরপর জনৈক সাইফ, রুবেল, রবিন, সাগর, মারুফ, সোহাগ শিহাবের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদীতায় প্রবেশ করে। এসব জঙ্গীদের মধ্যে একজনের ভিন্ন নামে পরিচিত আছে। তারা তাকে (নুরুজ্জামান) জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করে বিধর্মীদের হত্যা ও আক্রমণ করতে অনুপ্রাণিত করত। বিভিন্ন সময়ে সে ঝিনাইদহ এলাকায় স্কুল মাঠে ও একটি গ্যারেজে সমমনাদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করত। তাকে স্থানীয় জেএমবির পক্ষ থেকে একটি অটোরিক্সা ক্রয় করে দেয়া হয়। উক্ত রিক্সা চালানোর অজুহাতে সে বিভিন্ন এলাকায় রেকি করত এবং মুসলি থেকে ধর্মান্তরিত খ্রীস্টানদের অনুসরণ করত। ইতোমধ্যে জনৈক এক খ্রীস্টান যিনি সম্প্রতি মুসলিম ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল তাকে কুপিয়ে হত্যা করার জন্য সে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করত বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। বোমা বানাতে বিশেষভাবে পারদর্শী বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে নুরুজ্জামান।
×