ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্লভ বৃক্ষ নাগলিঙ্গম

প্রকাশিত: ১০:১২, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

দুর্লভ বৃক্ষ নাগলিঙ্গম

নাগলিঙ্গম। দুর্লভ একটি বৃক্ষ। এর ফুল বেশ আকর্ষণীয়, মনোরম। অদ্ভুত সুন্দর এ ফুলের পরাগচক্র দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। ধারণা করা হয়, এ কারণেই এ ফুলের নাম নাগলিঙ্গম। বেশির ভাগ উদ্ভিদের ফুল শাখায় ফুটলেও নাগলিঙ্গমের ফুল ফোটে গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি ফুঁড়ে বের হয় ছড়া। তারপর শত শত ফুল। ফুল ভর্তি গাছ দেখলে মনে করতেই পারেন, কেউ বুঝি গাছের কান্ড ছিদ্র করে ফুলগুলোকে গেঁথে দিয়েছেন। নাগলিঙ্গমের ফুল গাঢ় গোলাপি, সেই সঙ্গে হালকা হলুদ রঙের মিশ্রণ। পাপড়ি ছয়টি, পাপড়ি গোলাকার কুলিপাকানো এবং সৌরভের জন্যও সেরা। যেন ফণা তোলা সাপ। ফুলগুলো বেশ বড় বড়। এক কথায় দেখতে অসাধারণ! কি দিন, কি রাত, নাগলিঙ্গম গাছের পাশ দিয়ে গেলে এর তীব্র ঘ্রাণের মাদকতা আপনাকে কাছে টানবেই। প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মার মতে, ‘আপনি বর্ণে, গন্ধে, বিন্যাসে অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। এমন আশ্চর্য ভোরের একটি মনোহর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেকদিন আপনার মনে থাকবে।’ নাগলিঙ্গম ফুল সারা বছর ফুটলেও গ্রীষ্মকাল হচ্ছে নাগলিঙ্গম ফোটার উত্তম সময়। শীত এবং শরতকালে গাছে অপেক্ষাকৃত কম ফুল ফোটে। কিশোরগঞ্জ শহরের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে চারটি বড় নাগলিঙ্গম গাছ। এ গাছগুলো এখনও ফুলে-ফলে সুশোভিত। শহরবাসীকে সকাল-বিকেল সৌরভে মাত করে রাখছে এ গাছগুলো। এই গাছে ফুল ধরার পর বেলের মতো গোল গোল বড় আকারের ফল ধরে। এগুলো হাতির খুবই প্রিয় খাবার। এ জন্য আমাদের দেশে এটিকে হাতির জোলাপ গাছ বলা হয়। ফল হুবহু কামানের গোলার মতো হওয়ায় ইংরেজদের কাছে এ গাছের নাম ক্যাননবল। ‘ক্যাননবল’ অর্থাৎ কামানের গোলা! ফল পরিপক্ব হতে প্রায় এক বছর সময় নেয়। পরিপক্ব ফল মাটিতে পড়লে ফেটে যায়। বাতাসে খানিকটা ঝাঁজাল গন্ধ সৃষ্টি হয়। ফল পরিপক্ব হলে এমনি এমনি মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় গাছের নিচ দিয়ে না যাওয়াই ভাল। কারণ দ্বিস্তরের শক্ত আবরণযুক্ত ‘ক্যাননবল’ মাথায় পড়লে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ফল মূলত পশু পাখির খাবার। আমাদের জন্য এ ফল অখাদ্য, এমনকি ক্ষতির কারণও হতে পারে। তবে আমাজান বনের সামান জনগোষ্ঠীর কাছে এটি একটি প্রিয় খাবার! তাদের বিশ্বাস পুরুষত্ব বৃদ্ধিতে এ ফল বিশেষ ভূমিকা রাখে। নাগলিঙ্গম এর গাছ ৩৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। কান্ডও বেশ মোটা। গুচ্ছ পাতাগুলো খুব লম্বা, সাধারণভাবে ২৮ থেকে ৩১ সেন্টিমিটার, কিন্তু ৫৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বায় পৌঁছতে পারে। গাছের বাকলের রং ধূসর এবং অসমান। আমাদের দেশে অনেকেই এই গাছকে নাগেশ্বর বলে জানেন। নাগেশ্বর কিন্তু নাগলিঙ্গম থেকে একটু আলাদা। নাগলিঙ্গমের আরও দুটি ভিন্ন প্রজাতির নাম হলো-নাগেশ্বর এবং নাগকেশর। ফ্রান্সের উদ্ভিদবিদ জে.এফ আবলেট ১৭৫৫ সালে এ গাছের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন ‘ক্যুরুপিটা গুইয়ানেন্সিস’ (Couroupita Guianensis)। নাগলিঙ্গমের আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। পৃথিবীতে এ গাছ এখন বিলুপ্তির পথে। নাগলিঙ্গম গাছের রয়েছে ব্যাপক ঔষধিগুণ। এর ফুল, পাতা ও বাকলের নির্যাস থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি হয়। এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল, এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এর নির্যাস। এই গাছ থেকে তৈরি ওষুধ পেটের পীড়া দূর করে। পাতার রস ত্বকের নানা সমস্যায় কাজ দেয়। ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে নাগলিঙ্গমের পাতার রস ব্যবহার হয়। আমেরিকার আমাজান অঞ্চল ও ভেনিজুয়েলার আদিবাসীরা নাগলিঙ্গম ফলের খোসাকে এক সময় বাসন হিসেবে ব্যবহার করত বলে জানা যায়। এর কাঠ থেকে আসবাবও তৈরি হয়। বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে নাগলিঙ্গম যতেœ রোপণ করা হয়। এ কারণে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গণে নাগলিঙ্গম গাছ বেশি দেখা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শিব পূজায় নাগলিঙ্গম ফুল ব্যবহার করে। ভারতে নাগলিঙ্গমকে ‘শিব কামান’ নামে ডাকা হয়। রূপে গুণে ভরপুর এই উদ্ভিদের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে খুবই কম। বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি নাগলিঙ্গম গাছ টিকে আছে। রমনা উদ্যান, কার্জন হল, বলধা বাগান, নটরডেম কলেজ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ও হবিগঞ্জে দু’একটি গাছ এখনও দেখতে পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় সম্ভবত একটি পুরনো গাছ রয়েছে। এছাড়া লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এবং চন্দ্রিমা উদ্যানে বিভিন্ন বয়সী কয়েকটি নাগলিঙ্গম গাছ আছে। শ্রীমঙ্গলের চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ভবনের ঠিক সামনে রয়েছে বিশাল একটি নাগলিঙ্গম গাছ। বান্দরবান এবং কক্সবাজারের কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গণেও এ গাছ দেখা যায়। কিশোরগঞ্জ শহরের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে নাগলিঙ্গম গাছে সাঁটানো তথ্য থেকে জানা যায়, সত্তর দশকে বিদ্যালয়ের বৃক্ষপ্রেমী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত মতিউর রহমানকে তার এক ছাত্র বিদেশ থেকে নাগলিঙ্গমের চারা এনে দিয়েছিলেন। পরে প্রধান শিক্ষক মাঠের পূর্ব প্রান্তে চারা রোপণ করলে সেই গাছের ফল থেকে এখন চারটি গাছ হয়েছে। আজিম উদ্দিন বিদ্যালয়ের পাশের বাসিন্দা জুনাইদ (৩০) এ প্রতিবেদককে জানান, নাগলিঙ্গমের ফলগুলো খাবার যোগ্য কি না, পরীক্ষা করার জন্য তিনি একবার ফলে কামড় দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুখে জ্বালাপোড়া শুরু হলো। একপর্যায়ে সমস্ত মুখ ফোলে বিকৃত হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, পত্রিকায় নাগলিঙ্গমের গুণাগুণের খবর পড়ে একবার এক ব্যক্তি গাছের পাতা দিয়ে দাঁত মাজেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। অর্থাৎ গাছের রস বিষাক্ত বলে তাদের মনে হয়েছে। -মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ থেকে
×