ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুই দিনের রাজা!

প্রকাশিত: ১৩:২০, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

দুই দিনের রাজা!

বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশের মতো ফ্রান্সেও রাজতন্ত্র ছিল। রাজতন্ত্রের ফলে কেবলমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরাই উত্তরাধিকারসূত্রে রাজ্যের শাসনভার পেতেন। ঊনবিংশ শতকে কিং লুইসও উত্তরাধিকারসূত্রে মাত্র ২০ মিনিটের জন্য রাজা হয়েছিলেন। তিনি দশম চার্লসের পুত্র। দশম চার্লস ছিলেন ষোড়শ কিং লুইসের ছোট ভাই। ১৮০০ সালের গোড়ারদিকে ফরাসী বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ে। রাজপরিবারের অনেককেই হত্যা করা হয়। অনেকে ফ্রান্স থেকে নির্বাসিতও হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য রাজপরিবারের জীবিত লোকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। ১৮২৪ সালে ফ্রান্সের রাজা মারা যাওয়ার পর, যেহেতু তার কোন পুত্রসন্তান ছিল না। তাই উত্তরাধিকার নিয়ম মেনে সিংহাসনের দায়িত্ব বর্তায় দশম চার্লসের কাঁধে। রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় বহু সংস্কার করেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের ওপর জনগণের বিশ্বাস বা আস্থা ছিল না। সাধারণ জনগণ পরিবর্তন চাইছিল। ফলে ফ্রান্সজুড়ে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। চাপ সামলাতে না পেরে দশম চার্লস সিংহাসন ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে ঊনবিংশ কিং লুইসকে সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু রাজপরিবারে রাজা হওয়ার মতো জনপ্রিয়তা তার ছিল না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য- রাজা হওয়ার মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং স্কটল্যান্ডে পালিয়ে যান। চীনের জিন রাজবংশের সম্রাট মো ১১১৫ সালের দিকে উত্তর চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক রাজবংশের নাম ছিল জিন রাজবংশ। তাদের মধ্যে রাজা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিদায়ী রাজার ভূমিকা ছিল বেশি। তিনি উত্তরাধিকার নির্বাচন করার অধিকার রাখতেন। তবে অন্যান্য রাজতন্ত্রে যেমন রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা একজন মাত্র মানুষের ওপর অর্পিত ছিল, জিন রাজবংশে এমন হতো না। রাজা থাকলেও রাজ্যের বিভিন্ন দায়ভার রাজবংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভাগ করে দেয়া হতো। জিন রাজবংশের রাজারা অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী ছিলেন। যে কোনো সাম্রাজ্যের মতো এদেরও বহিঃশত্রুর অভাব ছিল না। শত্রুদের মধ্যে চেঙ্গিস খান এবং সং রাজবংশ ছিল অন্যতম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জিন রাজবংশ এদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ চলাকালীন ১২২৪ সালে সম্রাট জুয়ানজং মারা যাওয়ার পর তার পুত্র আইজং সম্রাট হন। আইজং সফল শাসক ছিলেন। তিনি যুদ্ধে লিপ্ত প্রায় সব রাজ্যের সাথে শান্তিচুক্তি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি এগদেই খান সং রাজবংশের সাথে সম্মিলিতভাবে জিন রাজবংশের রাজ্য আক্রমণ করেন। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে সম্রাট আইজং কাইজৌতে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে শত্রু দ্বারা অবরুদ্ধ অবস্থায় আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, নিজ চোখে জিন রাজবংশের পতন দেখতে চাননি বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তবে পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি তার জেনারেল মো-কে সম্রাটের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শত্রুরা কাইজৌ দখল করে নেয়। সম্রাট হওয়ার মাত্র একদিনের মাথায় যুদ্ধে সম্রাট মো নিহত হন। জার্মানির চ্যান্সেলর জোসেফ গোয়েবলস এ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠ মিত্র জোসেফ গোয়েবলস ১৯২০ সালে নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এবং যুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের সবচেয়ে কাছের লোক ছিলেন তিনি। জোসেফ মিষ্টভাষী, লেখক এবং সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার পর জোসেফ গুরুত্বপূর্ণ পদে মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। নাৎসি পার্টির প্রচার এবং জনসংযোগ শাখার দায়িত্ব হিটলার তার হাতে ন্যস্ত করেছিলেন। মিডিয়া এবং সাহিত্যের মধ্য দিয়ে জার্মানদের মধ্যে সেমিটিকবিরোধী মনোভাবের বীজ বপনে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জোসেফ একটি প্রচারমূলক চলচ্চিত্র তৈরি করেন। জার্মান দর্শক মহলে সেই সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দেয়া হয়েছিল যে, নাৎসি পার্টি যা করছে তা দেশ এবং বিশ্বের মঙ্গল বয়ে আনবে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে হিটলার আত্মহত্যা করার আগে তার সবচেয়ে কাছের এই সহচরকে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলরের পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চ্যান্সেলর হওয়ার ঠিক একদিন পর জোসেফ গোয়েবলস ছয় সন্তান এবং স্ত্রী মগদাকে নিয়ে জার্মানিতে হিটলারের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেন। জাঞ্জিবারের সুলতান খালিদ বিন বারঘাশ পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ জাঞ্জিবার শাসন করতেন মুসলিম সুলতানরা। সুলতান খালিদ বিন বারঘাশ ছিলেন তাদের একজন। সুলতান হওয়ার আগ থেকেই তিনি জনগণের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। জাঞ্জিবারের লোকেরা তাকে ভালবাসত এবং সম্মান করত। তবে দুর্ভাগ্যবশত তিনি জাঞ্জিবারের সুলতান হয়েছিলেন মাত্র দুই দিনের জন্য। তিনি ছিলেন জাঞ্জিবারের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শাসক সাইদ বারঘাশ বিন সাইদ আল বুসাইদের ছেলে। ১৮৯০ সালের দিকে পূর্ব আফ্রিকার এই দ্বীপটি ব্রিটিশরা কব্জা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই তারা মসনদে তাদের অনুগত কাউকে বসাতে চাইছিল। কারণ, সুলতানের তুমুল জনপ্রিয়তা ব্রিটিশদের মনে আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। সুলতান বারঘাশ ব্রিটিশদের নবনির্বাচিত সুলতানের কাছে সালতানাত ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্রিটিশরা জাঞ্জিবার উপকূলে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর কিছুদিন পর তারা সুলতানের প্রাসাদ আক্রমণ করে এবং তাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। সুলতান হওয়ার মাত্র দুই দিনের মাথায় আত্মসমর্পণ করে বারঘাশ জাঞ্জিবারকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যান। নেপালের রাজা দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব রাজা হওয়ার আগে দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ছিলেন নেপালের ক্রাউন প্রিন্স। রাজা হিসেবে অভিষেকের ঘটনা তার জন্য মোটেও সুখের ছিল না, বরং শোকের ছিল। জনশ্রুতি আছে তিনি ভারতীয় রাজপরিবারের কোন এক রাজকুমারীর প্রেমে মত্ত হয়েছিলেন এবং তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নেপালের রাজপরিবারের সেই বিয়েতে সায় ছিল না। ২০০১ সালের ১ জুন তিনি তার বাবা রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, মা রানী ঐশ্বরিয়াসহ রাজপরিবারের আরও আট সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। তারপর নিজেও মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তার মৃত্যু হয়নি। বাজেভাবে আহত হয়ে কোমায় চলে যান তিনি। যেহেতু তিনি নেপালের ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তাই রাজা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনিই নেপালের রাজার পদ পান। তবে রাজা হিসেবে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। রাজ্যাভিষেক হওয়ার তিন দিন পর কোমায় থাকা অবস্থাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারপর উত্তরাধিকারসূত্রে তার চাচা রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব নেপালের সিংহাসনে বসেন। ফ্রান্সের প্রথম কিং জন প্রথম কিং জন ছিলেন দশম কিং লুইসের পুত্র। দশম কিং লুইস ১৩১৬ সালের জুন মাসে মারা যান। তখনও প্রথম কিং জনের জন্ম হয়নি। অর্থাৎ জন্মের আগেই সিংহাসনের অধিকারী হন তিনি। যদিও ওই বছর ১৫ নবেম্বর তিনি ভূমিষ্ঠ হন। রাজতন্ত্রের নিয়ম মেনে এই শিশুকেই ফ্রান্সের মসনদে বসানো হয়েছিল। কিন্তু মাত্র পাঁচদিন বয়সেই অজানা কারণে মারা যান প্রথম কিং জন। মৃত্যুর কারণ আজ অবধি ইতিহাসবিদদের কাছে অস্পষ্ট। তবে অনেকেই চাচা পঞ্চম ফিলিপকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ফোর্ড ফ্রাঙ্ক ফোর্ড অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি লেবার পার্টির ফেডারেল প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি অস্ট্রেলিয়া সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী, সেনামন্ত্রী, যুদ্ধ পরিষদের উপদেষ্টা সদস্য এবং শুল্কমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল দুর্দান্ত। সর্বস্তরের জনগণ এবং নেতৃস্থানীয় লোকেদের কাছেও তিনি তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। এ কারণেই ১৯৪৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন কার্টিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে, ফ্রাঙ্ক ফোর্ড অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার নিজের দল লেবার পার্টিই তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না। বেন চিফলেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে তারা। ফ্রাঙ্ক ফোর্ড ৬ জুলাই থেকে ১৩ জুলাই অর্থাৎ সাতদিন অস্ট্রেলিয়ার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইংল্যান্ডের কুইন লেডি জেন গ্রে ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী স্বভাবের অধিকারিণী কুইন লেডি জেন গ্রে ছিলেন অষ্টম কিং হেনরির ভাতিজী। ইংল্যান্ডের সিংহাসনের দৌড়ে তার অবস্থান ছিল পঞ্চম। ১৫৩৭ সালে কিং হেনরি মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকারসূত্রে তার পুত্র ষষ্ঠ এডওয়ার্ড ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। তবে কিং এডওয়ার্ড ক্ষয়রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ৬ জুলাই ১৫৫৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা ছিল, তার চাচাত বোন লেডি জেন গ্রে হবেন ইংল্যান্ডের নতুন শাসক। কিন্তু লেডি জেন গ্রে’র রাজ্যাভিষেকের পর তার সৎ বোন মেরি টিউডর বিদ্রোহ করেন। কারণ উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী ষষ্ঠ কিং এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসার কথা ছিল মেরির। রাজমহলে মেরির পক্ষে ক্রমেই সমর্থন বাড়তে থাকে। ফলে সিংহাসনে বসার মাত্র নয়দিনের মাথায় লেডি জেন গ্রে’কে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয়। ১৫৫৩ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই তিনি ইংল্যান্ডের রানী হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। ইতালির দ্বিতীয় কিং উম্বের্তো উম্বের্তো ছিলেন ইতালির তৎকালীন শাসক তৃতীয় কিং ভিটোরি ইমানুয়েলের পুত্র। ইউরোপের অন্যান্য রাজতন্ত্রের মতো ইতালির রাজপরিবারও শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে এমন একজন শাসকের সন্ধানে ছিল। আর তখন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়েই সরব আন্দোলন চলছিল। ইতালিতেও সেই হাওয়া লেগেছিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬ সালে ইতালিতে রাজতন্ত্রের পক্ষে-বিপক্ষে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। রাজতন্ত্র বিরোধীদের দমনের প্রত্যাশায় তৃতীয় কিং ভিটোরি তার পুত্রের হাতে রাজ্যের দায়ভার তুলে দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করেন। কিন্তু এই ঘটনা ইতালির জনগণের মনে রাজতন্ত্রের পক্ষে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপুল ভোট দেয় সাধারণ জনগণ। এই গণভোটের পরপরই ইতালিতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং প্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার শুরু হয়। দ্বিতীয় কিং উম্বের্তো ছিলেন ইতালির মাত্র কয়েকদিনের এবং সর্বশেষ রাজা। সিংহাসনচ্যুত হওয়ার পর তাকে পর্তুগালে নির্বাসিত করা হয়। জীবনের বাকি দিনগুলো তিনি নির্বাসিত অবস্থাতে পর্তুগালে থেকেই মারা যান।
×