ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

শান্তা সূত্র ধর ॥ এগিয়ে চলা সংস্কৃতি কর্মী

প্রকাশিত: ১৩:১৯, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

শান্তা সূত্র ধর ॥ এগিয়ে চলা সংস্কৃতি কর্মী

সর্বক্ষেত্রে নারীদের সামনের দিকে পথ নির্দেশনা দেশের সমৃদ্ধির অন্যতম সূচক। এক সময়ের অন্তঃপুরবাসী, ঘরে আটকে থাকা নারীরা সদর্পে, প্রত্যয়ী মনোবলে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়তই অগ্রসরমান হওয়ার দৃশ্য আজ স্পষ্ট, সবার সামনে উন্মোচিত। পরিবারের ক্ষুদ্র আলয় থেকে বৃহত্তর সামাজিক আঙ্গিনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে আজও নারীদের ভাবতে হয়, পিছুটানে থমকে যাবার চিত্রও কম নয়। শান্তা সূত্র ধর তেমনই এক উদ্দীপ্ত নারী যে কিনা বদ্ধ সংস্কারের আবহকে পশ্চাতে ফেলে নিজেকে শাণিত করতে সব সময়ই সাহসী এবং স্বাধীনচেতাও বটে। এই সংস্কৃতি কর্মীর সঙ্গে আলাপকালে বুঝতে অসুবিধা হয়নি প্রচলিত সমাজ-সংসারের হরেক রকম বন্ধন জালকে ছিন্ন করে প্রতিনিয়ত সামনের দিকে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়েছে। গাইবান্ধার বোনারপাড়া গ্রামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেয়া শান্তা অতি বাল্যকাল থেকে আপন চেতনায় নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে বিদ্যমান সংস্কারকে সেভাবে তোয়াক্কাও করেনি। বাবা বীরেন্দ্রনাথ সূত্রধর একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। মা সুষমা রাণী সংসার সামলানো এক অভিজ্ঞ গৃহিণী। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে শান্তা মেজ। বড় ভাই রাজশাহী প্রকৌশল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী অর্জন করা একজন প্রকৌশলী। বোনারপাড়া আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্জনের সময় থেকেই মঞ্চের প্রতি এক প্রকার আগ্রহ এবং উৎসাহ তাকে সাংস্কৃতিক কর্ম দ্যোতনার বীজ বপনে সহায়তা করে। পারিবারিকভাবে কোন সাংস্কৃতিক আবহের সঙ্গে পরিচিত না হয়েও ভেতর থেকে শুদ্ধ চেতনার যে নির্মল অভিব্যক্তি তাও যেন অন্তর্নিহিত বোধের এক অবিমিশ্র মনন শক্তি। যে সাহস আর অভিব্যক্তিকে নিজের মধ্যে লালন ধারণ করার অনমনীয় দ্যোতনা পরবর্তীকালের হরেক রকম কর্মযোগে তার ছাপ পড়তে সময় লাগেনি। স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাঠগ্রহণকালে বিদ্যালয়ের এক বনভোজনে লোকনৃত্যের প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করা। সে অবধি নাচ-গানের কোন প্রশিক্ষণ কিংবা তেমন চর্চাও ছিল না। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসমত আরা বেগমকে এখনও ভুলতে পারেননি শিক্ষার্থীদের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কারণে। নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে অধ্যবসায় পাঠক্রমের প্রতি আন্তরিক মনোসংযোগের ব্যাপারে এই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকের নজরদারি ছিল আসাধারণ। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণ করে ভর্তি হয় ঐ অঞ্চলের উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শান্তা ছিল বিজ্ঞানের ছাত্রী। তবে পারিবারিক আগ্রহে উচ্চ মাধ্যমিকের বিষয় হয়ে যায় মানবিক। বড় ভাই মনে করতেন বিজ্ঞান পড়ার চাইতে মানবিক বিভাগই মেয়েদের জন্য উত্তম বিষয়। যাই হোক সেসব স্মৃতি হলেও আক্ষেপের বিষয় একেবারেই নয়। দাদা তখন রুয়েটে পড়াশোনা করছে। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আরও উচ্চশিক্ষার ব্যাপারটি যখন সামনে চলে আসে সে সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনায় আনা হয়। পরীক্ষা পাসের আগমুহূর্তে কোন কোচিং নিয়ে ভাবেওনি ভর্তির প্রতিযোগিতার জন্য। যখন রাজশাহী আসা হলো যে সময় অন্য অনেকের সঙ্গে কোচিংয়েও প্রবেশ করতে হয়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। তার পরেও সাজানো, গোছানো মনোরম পরিবেশে উচ্চশিক্ষা নিতে এই প্রতিষ্ঠানকেই বিবেচনায় আনা হয়। ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয় মনোবিজ্ঞানে। বিষয়টির প্রতি ব্যক্তিগত আকর্ষণও ছিল প্রবল। মানুষের মনোজাগতিক অবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আরও গভীর আর সূক্ষ্মভাবে জানার অদম্য স্পৃহায় বিষয়ের প্রতি নিবেদিত হতে ভাবতে হয়নি। বাল্যকাল থেকে সংস্কৃতিচর্চার প্রতি যে অনমনীয় চেতনা বৃহত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্মুক্ত পরিবেশে এসে তা আরও প্রবলভাবে শাণিত হতে থাকে। ফলে স্বনন আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়া সেও সাংস্কৃতিক বোধের এক অনন্য দীপ্তি। ইতোমধ্যে সহপাঠী হিসেবে রিপন ঘোষের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা জীবনের গতি নির্ধারণে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। উদীয়মান এই তরুণ বিষয় থেকে আরম্ভ করে মননচর্চার শৈল্পিক অনুভবে প্রভাব ফেলতেও বিশেষ সহযোগিতা দিয়ে যায়। ছোট বয়স থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে বিশ্বকবির প্রতি যে আন্তরিক নিবেদন সেখান থেকে আবৃত্তির বিষয়ও নির্ধারণ হয়ে যেত। ‘দুই পাখি’ কিংবা দুই বিঘা জমি সেভাবে স্মরণ চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে আছে। সমাপ্তির মৃন্ময়ী বা পোস্ট মাস্টারের রতনের প্রতি আগ্রহ কখনও কমেনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ সমাপ্ত করে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া এই মনন শিল্পী কর্ম জীবনেও তার দক্ষতার পরিচয় দেন। সাংস্কৃতিক চেতনায় যে অতি বাল্যকাল থেকে সমর্পিত উত্তরকালে পেশাগত জীবনেও পড়ে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব। শিশু ধর্ষণ ও অধিকার নিয়ে কাজ করার পুরস্কারও পেয়ে যায়। এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিয়ন এওয়ার্ড ২০১৭ সম্মান এবং ইউনিসেফের মীনা মিডিয়াও তাকে সম্মাননা দেয়। সহপাঠী রিপন ঘোষ এখন তার জীবনসঙ্গী। দু’জনই ভিন্ন ভিন্ন এনজিওতে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত আছেন। শান্তা কাজ করছে লিঙ্গ বৈষম্যের ওপর। সাহসের সঙ্গে আরও এগিয়ে যাবে শান্তা।
×