ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

নারীর ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ১৩:১৮, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

নারীর ক্ষমতায়ন

(পূর্ব প্রকাশের পর) সংসদে বসে তারা কোন ফলদায়ক আলোচনা কিংবা মাসব্যাপী বাজেট সেশনের আলোচনা অংশ নেবে এমন তাদের অনেকেরই সক্ষমতা নেই। নারীর সংরক্ষিত আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক দলের আকারে ওপর অর্থাৎ যে দলের প্রতিনিত্বি সংসদে যত বেশি তাদের সংরক্ষিত আস সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি এবং এই আসনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে আসে যেম পিতা, চাচা কিংবা মামা সংসদ সদস্য ছিল এমন একজনকে সেই পরিবার থেকে নির্বাচিত করা হয়। আবার যারা জেলা কিংবা মাঠ পর্যাযের জাতীয় রাজনৈতিক দলের মহিলা শাখার নেতৃত্বে থাকে তাদের মধ্যে থেকে সংরক্ষিত সে জেলার আসনে নির্বাচিত করে থাকে যাদের সংসদীয় কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই বলে চলে। কেবল প্রতিনিধিত্ব করাই মূল বিষয় যা সমাজ, রাজনীতি ও সুশীল সাংবাদিক বৃন্দ অনেকটাই সমালোচনার চোখেই মূল্যায়ন করে যার ফলে অনেকই অস্বস্তি বোধ করে। আশির দশকের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসনামলে বাংলাদেশের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারীর আসন ছিল ৩০টি এবং এনটিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সাংবাদিক শফিক রেহমান তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকার যায়যায় দিনে প্রকাশিত ফিচার সংসদের শোভা ত্রিশ সেট অলঙ্কার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল যা কেবল রুচি বিবর্জিতই নয়, মানহানিকরও বটে। বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে এ রকম হাস্যরস উপহাসমূলক সংবাদ যে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা একেরাইে উড়িয়ে দেয়া যায় না। নারীবাদী সংগঠনগুলো এই সকল সংরক্ষিত আসনের বিলুপপ্তি চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব চায়। এই ধরনের যখন একটি সেন্টিমেন্ট রাজনীতির অঙ্গনে বিরাজমান তখনই গত ৮ জুলাই সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদের সপ্তদশ সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ আর ২৫ বছর বাড়ানো হয়েছে সত্যি কিন্তু অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে দেশের রাজনীতির কিংবা সমাজনীতিতে নারী সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করছে বা করবে তা জোড় দিয়ে যেমন বলাও যায় না একইভাবে বিষয়টিকে উপেক্ষাও করা যায় না। তবে যে পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় তাতে নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু সংগঠিত হচ্ছে সে প্রশ্ন রয়েই যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় সাধারণ সদস্যদের প্রতিনিধত্বের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলো সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে অথচ পূর্বের ব্যবস্থা ছিল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এককভাবে সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের বেছে নিত। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদের প্রধান সম্যসাগুলো হলো তাদের জেলা ওয়ারী দায়িত্ব দেয়া হয় কোন নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নয়। ফলে সংসদীয় আসনের বিপরীতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের কোনরূপ গুরুত্ব দেয়া না বিশেষত উন্নয়ন বাজেট বিতরণে কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যা অনেকটা গলগ্রহের শামিল বলে প্রতীয়মান। আবার স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও তাদের মানতে চায় না। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ কথা বলা হয়েছিল যা পরবর্তীতে অর্ধেক পূরণ হয়েছে মাত্র। কিন্তু জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে কতজন প্রতিনিধি রয়েছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যদের সমান অধিকার কিংবা সুযোগ ভোগ করছে কি না। রাজনৈতিক দল বিধি অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ পদে নারীদের জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূূলক রয়েছে। কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কিংবা সংসদের বাইরে থাকা কোন দলই সেই সব শর্তের কাছাকাছিও আসতে পারেনি। এখানে একটি বাস্তব সমস্যা হলো নারী যোগ্য হলেও অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন দিতে চান না এই কারণে যে পারিবারিক পর্যায়ের একটি বাধা থাকে কিংবা তাদের নির্বাচনী ব্যয় মিটানোর জন্য তেমন কোন অর্থ সম্পদ থাকে না ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে আসন সংরক্ষিত হচ্ছে কিংবা আদৌ হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নটি বার বার আসছে সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গনে। এক সময় বিশেষত বা সত্তরের দশকে এর প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখন অনায়সেই নারীদের জন্য নির্ধারিত আসন সংরক্ষিত রেখে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন হলে ক্ষতি কি? বর্তমান প্রথা বাংলাদেশ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কারণ এখানে নির্দলীয় প্রার্থীদের সংরক্ষিত আসনে আসার কোন সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় উন্নযনশীল দেশের কাতারে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে যেহেতু দেশ রয়েছে সেহেতু এই বিষয়টির আধুনিকায়ন যে সব ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেয়া জরুরী তা হলোÑ এক : একটি দেশের উন্নয়নে অনেকগুলো মানদ-ের মধ্যে একটি হলো সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি। সেই ক্ষেত্র পূর্বের তুলনায় অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বিশেষত শিক্ষার কিংবা উচ্চ শিক্ষার হারে সরকারি; দ্বিতীয়ত : চাকরিতে, সংসদীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে কিন্তু আশঙ্কার কারণে হলো যে গতিতে ও যে পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা খুবই মন্থর বা নির্ভর নয়। এখন রাতারাতি নারী উন্নয়ন সম্ভব নয় তার সাতে সমাজ কাঠামো তথা পরিবার কাঠামো জড়িত যা বৈধ ধরে অপেক্ষা করতে হবে সংসদে নারীর প্রতিনিধত্ব বাড়ানোর জন্য সংরক্ষিত আসনকে বেছে নেয়া হয়েছে যা বিশ্বের কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলোতে বলবত রয়েছে বিশেষত সমাজের পশ্চাৎপদে শ্রেণীর জন্য যেমন হরিজন, দলীত শ্রেণী, সাঁওতাল ইত্যাদি। উপজাতি শ্রেণীর জন্য বাংলাদেশ নৃতাত্বিক শ্রেণী গোষ্ঠী তেমন নেই। আবার থাকলেও তারা এত বেশি পশ্চাৎপদ যে জাতীয় উন্নয়নে কিংবা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো অবস্থায় নয় তবে সরকার এক্ষেত্রে বিশেষত শিক্ষায় ও চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখেছে যার সুফল দেশ ধীরগতিতে পাচ্ছে । এখন নারীর সংরক্ষিত আসনে যে কায়দায় সংসদ সদস্য পদে দেয়া হচ্ছে তা না করে সেই আসনগুলোতে সরাসরি নারী প্রার্থীদের মাঝে সরাসরি ভোটের আয়োজন করা হয় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৩টি যার মধ্যে জনাকয়েক দল ছাড়া বাকি দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোতে সারাদেশের জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে-মৌজায় তাদের কোটা নেটওয়ার্ক পাওযা যাবে না। আবার বড় দলগুলোর জাতীয়/জেলা/ উপজেলা/ ইউনিয়ন পর্যায়ে মহিলা দলের যে কমিটিগুলো রয়েছে সেখানে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল কিবা বিএনপি ছাড়া তেমন কোন শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আর যারা কমিটিতে আছে তারা অনেকটা পরিবারতান্তিক যেমন মন্ত্রী, এমপি ও পারিবারিক সদস্য, নিকটতম আত্মীয় ইত্যাদি। আমার মতে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমের প্রক্রিয়া তৃণমূল থেকে শুরু হওয়া উচিত যা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে রয়েছে বাংলাদেশে অনুপস্থিত। সেই প্রক্রিযায় ইউনিয়ন/ উপজেলা/ জেলা/ বিভাগ/ জাতীয় পর্যায়ের সকল স্থরে যদি এই অনুশীলনগুলো করা হয় তা হলে আমাদের দেশের নারী কিংবা পুরুষ নেতৃত্বের অভাব হবে না এবং তখন নারীর জন্য সংরক্ষিত অমর্যাদাকর আসনগুলোর প্রযোজন পড়বে না যা নিয়ে সমাজের অনেকই হাসি-মস্করা করে থাকে; তৃতীয়ত : আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের জন্য নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই কিংবা নির্বাচনের কমিশন কর্তৃক তার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এর বাইরেও তেমন কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে রাজনৈতিক ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ হতে পারে। তাই দেশের সার্বিক কল্যাণে ও নারীর ক্ষমতায়নে সংরক্ষিত আসনের বিষয়টির রূপান্তর ঘটানো উচিত।
×