ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রেন দুর্ঘটনা- দায় কার

প্রকাশিত: ১২:২০, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

ট্রেন দুর্ঘটনা- দায় কার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেল স্টেশনের সন্নিকটে মঙ্গলবার গভীর রাতে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ১৬ যাত্রী নিহত এবং নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। এ ক্ষেত্রে যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না তা হলো, প্রধানত তুর্ণা নিশিথা এক্সপ্রেসের চালকের চূড়ান্ত গাফিলতি ও অসতর্কতা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, ট্রেনটি সঙ্কেত অমান্য করে উদয়ন এক্সপ্রেসের মাঝামাঝি একাধিক বগিতে ঢুকে যায় তীব্র বেগে। চালকের ব্রেক করার সুযোগ থাকলেও তিনি তা করেননি বলে অভিযোগ আছে। যার ফলে অনিবার্য ঘটে এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা। ঝরে যায় বেশ কয়েকজন নিদ্রাকাতর যাত্রীর প্রাণ। আহত হন অর্ধ শতাধিক। ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকারী দল অকুস্থলে ছুটে যায়। সরেজমিন পরিদর্শনে গেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। দুর্ঘটনায় মৃত ও আহতদের জন্য গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে সংশ্লিষ্ট চালক ও সহকারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এটুকুই যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে বলার অবকাশ আছে বৈকি। জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ১০ বছরে তিন শতাধিক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে নিহতের সংখ্যা ২২২২ জন। এর জন্য প্রধানত দায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়মিত-অনিয়মিত কর্মীদের গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, সর্বোপরি ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থা ইত্যাদি। আরও যা দুঃখজনক তাহলো ৩০ বছর আগেও যেসব কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে দীর্ঘদিনেও তার কোন পরিবর্তন হয়নি। যেসব কারণে প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে, তার মধ্যে অন্যতম হলোÑ সর্বত্র ডবল লাইন নির্মিত না হওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ ও অরক্ষিত লেবেল ক্রসিং, দক্ষ ও যোগ্য লোকবলের অভাব, চুক্তিভিত্তিক চালক-কর্মী নিয়োগ, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা। প্রধানমন্ত্রী এক প্রতিক্রিয়ায় যথার্থই বলেছেন, ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দরকার। প্রশ্ন হলো, এটাও কেন প্রধানমন্ত্রীকেই বলতে হবে? তাহলে রেলমন্ত্রী, রেলসচিব, রেলের মহাপরিচালকসহ অন্যদের কর্তব্য ও করণীয় কি? প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও কেন তারা রেলকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে পারছে না? সম্প্রতি দুদকের একটি টিম বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে রেলের দুর্নীতির অন্তত ১০টি উৎস চিহ্নিত করেছে। দুদকের মতে, রেলের কেনাকাটা ও বিক্রির প্রতিটি স্তর এবং রেলের জমি এবং জলাশয় ইজারা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। রেলের কারখানাগুলোসহ সঙ্কেত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নড়বড়ে রেলপথ ও ভাঙ্গা ব্রিজ সংরক্ষণ এমনকি ডাবল লাইন-মিশ্র লাইন নির্মাণেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে থাকে। এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৫ দফা সুপারিশও করা হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে, যা প্রতিবেদন আকারে তুলে দেয়া হয়েছে রেলমন্ত্রী ও রেল সচিবের হাতে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে দুর্নীতির কারণে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের খবরও আছে। দুঃখজনক হলো স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলোর অমনোযোগ ও অবহেলা এবং সড়ক পরিবহন ও যানবাহন মালিক সমিতির চাপে, সর্বোপরি রাজনৈতিক কারণেও বটে রেলপথের পরিবর্তে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নে। এতে একশ্রেণীর আমলা-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের অবাধ লুটপাট ও দুর্নীতির সুযোগ ঘটে। যে কারণে সড়কপথের তুলনায় এতদিন অবহেলিত ছিল রেলপথ। অথচ জনসংখ্যা বিবেচনায় রেলপথই হতে পারে বাংলাদেশের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সাশ্রয়ী, দ্রুতগামী, নিরাপদ ও আরামপ্রদ মাধ্যম যোগাযোগের ক্ষেত্রে। তবে এর জন্য দেশব্যাপী সর্বাধুনিক রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে সর্বাগ্রে। তবে সর্বাগ্রে রেলওয়ের বিদ্যমান অনিযম অব্যবস্থাপনা, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি কঠোর হস্তে প্রতিরোধ করতে না পারলে আদৌ কোন সুফল পাওয়া যাবে না। আমরা কসবার মন্দবাগ রেল স্টেশনে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনাসহ আহত ও স্বজনদের জানাই গভীর সমবেদনা, সেইসঙ্গে যথাযথ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ।
×